জয় বাংলাদেশ : লেবানন দেশটার দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে এখন আতঙ্ক। অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে সেখানকার বাসিন্দাদের। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, ট্রাকে করে যে যেভাবে পারছেন ছুটছেন দেশের উত্তরের দিকে। তাঁদের চাওয়া একটাই—প্রাণে বাঁচা।
দক্ষিণ লেবাননের বাসিন্দারা প্রাণে বাঁচতে চাইছেন ইসরায়েলের বোমা হামলা থেকে। ২০০৬ সালে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের পর গতকাল সোমবার সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন দেখেছে লেবানন। এদিন দেশটির দক্ষিণাঞ্চল ও পূর্বের কয়েকটি এলাকায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় অন্তত ৫৫৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ৮০০ জনের বেশি মানুষ।
অসহায় পাঁচ সদস্যের এক পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তাঁরা দক্ষিণের একটি গ্রামের বাসিন্দা। একটি মোটরসাইকেলে করে পাঁচজন বৈরুতে পৌঁছেছেন।
ইসরায়েল বলছে, লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে তারা এ হামলা চালাচ্ছে। হামলা হওয়া এলাকাগুলো থেকে সবাইকে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। এ–সংক্রান্ত খুদে বার্তা ও অডিও বার্তা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন দক্ষিণ লেবাননের কয়েকজন বাসিন্দা।
গতকাল দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েল ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছেন এ অঞ্চলের নাবাতিয়েহ শহরের শিক্ষার্থী জাহরা সাওলি। তিনি বলেন, ‘সকাল ছয়টায় বোমার শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দুপুর নাগাদ বোমা হামলা তীব্র হতে থাকে। আমার এলাকায় অনেক হামলা হয়েছে। কাচ ভাঙার মুহুর্মুহু শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।’
শহরের আরও অনেকের মতো জাহরা সাওলিও গতকাল অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। ভবনে যাঁদের সঙ্গে তিনি ছিলেন, কেউ বের হননি। সাওলি বলেন, ‘আমরা কোথায় যেতাম? অনেক মানুষ এখনো সড়কেই আটকে আছেন। যেমন আমার অনেক বন্ধুবান্ধব শহর ছেড়ে পালানোর সময় যানজটে আটকে গেছে।’
নানা আশঙ্কা ও আতঙ্কের মধ্যেই বৈরুতের অনেক বাসিন্দা আবার ইসরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সাওলি যেমনটি বলেছেন, দক্ষিণ লেবাননের শহরগুলোর সড়কের অবস্থাকে তার চেয়ে কোনো অংশে ভালো বলা যাবে না। সোমবার দুপুরের আগেই নাবাতিয়েহ থেকে রাজধানী বৈরুতগামী সড়কগুলোয় যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। দেখা দেয় তীব্র যানজট। দক্ষিণের আরেক শহর তীর–এর বাসিন্দাদের সমুদ্রসৈকত ধরে উত্তরের দিকে এগোতে দেখা গেছে কয়েকটি ছবিতে।
এমনই অসহায় পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তাঁরা দক্ষিণের একটি গ্রামের বাসিন্দা। একটি মোটরসাইকেলে করে পাঁচজন বৈরুতে পৌঁছেছেন। পরের গন্তব্য আরও উত্তরের ত্রিপোলি শহর। তবে এরই মধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাঁরা। ওই পরিবারের প্রধান বলছিলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে কী জানতে চাচ্ছেন? পালানো ছাড়া আমাদের কোনো পথ ছিল না।’
আতঙ্ক বৈরুতের বাতাসেও। দক্ষিণ থেকে যখন মানুষজন পালিয়ে রাজধানী শহরে এসে আশ্রয় খুঁজছেন, তখন এই শহরের অনেকেই নানা আশঙ্কায় পালিয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ, হামরাসহ বৈরুতের অনেক এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরে যেতে বার্তা পাঠিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। যদিও এসব এলাকায় হিজবুল্লাহর কোনো ঘাঁটি নেই।
ইসরায়েলের এমন সতর্কবার্তা পেয়ে স্কুল থেকে সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন মা–বাবারা। এমনই এক বাবা ঈসা। রয়টার্সকে তিনি বলছিলেন, ‘তারা সবাইকে ফোন করছে, আর হুমকি দিচ্ছে। তাই সন্তানকে স্কুল থেকে নিতে এসেছি। এই পরিস্থিতিতে কোনো কিছুর ওপর ভরসা পাচ্ছি না।’
স্ত্রীকে নিয়ে বৈরুত ছাড়ছিলেন মোহাম্মদ নামের আরেক ব্যক্তি। তিনি একজন ফিলিস্তিনি। রাজধানী ছাড়ছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লেবাননের কোনো জায়গাই আর নিরাপদ নয়। ইসরায়েল বলছে, তারা সব জায়গায় বোমা হামলা চালাবে। এখন এ এলাকাতেও হুমকি দিয়েছে। আমরা কোথায় যাব?’
এদিকে দক্ষিণ লেবানন থেকে আসা লোকজনকে আশ্রয় দিতে বৈরুত, ত্রিপোলিসহ উত্তর লেবাননের স্কুলগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। বেকা উপত্যকা থেকে পালিয়ে আসা মানুষের জন্য গতকাল পশ্চিম বৈরুতের বীর হাসান স্কুলটি প্রস্তুত করতে দেখা গিয়েছিল। সেখানে কাজ করা শ্রমিকেরা বলছিলেন, দিনের শেষ নাগাদ তাঁদের কাজ সম্পন্ন হবে। ইসরায়েলের হামলার কারণে লেবাননের হাসপাতালগুলোয়ও আহতদের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে।
নানা আশঙ্কা ও আতঙ্কের মধ্যেই বৈরুতের অনেক বাসিন্দা আবার ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। যেমন একজন বলছিলেন, ‘যদি পুরোপুরি যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে দল–মতনির্বিশেষে লেবাননের নাগরিক হিসেবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ, দিন শেষে আমাদের সবার ওপর বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে।’
তবে অনেকেই অসহায়। মোহাম্মদ সিবাই নামের বৈরুতের এক দোকানমালিক রয়টার্সকে বলছিলেন, ‘তারা (ইসরায়েল) যদি যুদ্ধ চায়, আমরা আর কী করতে পারি? এটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের কিছুই করার নেই।’
মোহাম্মদ নামের আরেকজনের ভাষ্য, ‘১৯৭৫ সাল থেকে সব যুদ্ধের পরও তো বেঁচে আছি। এই হামলা আমার জন্য স্বাভাবিক। আমি পালিয়ে যাব না। নিজের বাসাতেই থাকব।’