সিরিয়ার রাজধানী দামেশকে ইরানের কনস্যুলেটে প্রাণঘাতী হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। কনস্যুলেটে হামলা চালানোর কথা স্বীকার না করলেও এই আক্রমণের পিছনে যে ইসরায়েল রয়েছে এমনটা মনে করা হচ্ছে। এর আগে অবশ্য তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত ছিল তারা। ইসরায়েলও ইরানের ওপর অনুরূপ হামলা চালিয়েছে। তবে তারা কেউ হামলার দায় স্বীকার করেনি। এবারের ইরানি হামলার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইসরায়েলও ইরানের গুরুত্বপূর্ণ শহর ইস্ফাহানে কয়েকটি ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানকে সতর্কবার্তা দিয়েছে যে, ইরান যদি আবার ইসরায়েলে হামলা চালায় তাহলে তারা তাদের হামলা জোরদার করবে। এই দুই দেশের সম্মুখ যুদ্ধ পুরো বিশ্বের কাছে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ১৩ এপ্রিল ইরানের ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী (আইআরজিসি), ইরাকি পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস, লেবাননের গ্রুপ হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনি হুতির সাথে সমন্বয় করে ইসরাইল এবং ইসরায়েল দখলকৃত গোলান মালভ‚মির ওপর আক্রমণ শুরু করে। এই অপারেশনের কোডনাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ।’ এই হামলায় ড্রোন, ক্রুজ এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করা হয়। ১ এপ্রিল দামেশকে ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি বিমান হামলার চালিয়ে ১৬ ব্যক্তিকে হত্যা করার প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ শুরু হয়। ইরান-ইসরায়েল প্রক্সি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিশোধমূলক হামলা ছিল দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ।
গত ১৪ এপ্রিল জাতিসংঘে ইরানের দূত বলেছেন যে, তাদের আক্রমণ ‘সমাপ্ত বলে মনে করা যেতে পারে।’ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে যে, ইরান প্রায় ১৭০টি ড্রোন এবং ১২০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ ৩০০টিরও বেশি প্রজেক্টাইল নিক্ষেপ করেছে, যার বেশিরভাগই সফলভাবে আটকানো হয়েছে বলে দাবি করেছে। এই প্রজেক্টাইলের বেশিরভাগই অ্যারো ৩ এবং ডেভিডের স্লিং ইন্টারসেপশন সিস্টেম। ক্ষেপণাস্ত্রের কিছু অংশের আঘাতে শুধু একজন ইসরায়েলি বেদুইন শিশু আহত হয়েছে। সংরক্ষিত এলাকায় ছুটে যাওয়ার সময় আরো একত্রিশ জন উদ্বিগ্ন বা দুর্ঘটনাজনিত স্ব-প্রবর্তিত ছোটখাটো আঘাতের শিকার হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জর্ডান তাদের নিজস্ব বাহিনী ব্যবহার করে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলকে সহায়তা করে এবং ফ্রান্স তার নৌবাহিনী মোতায়েন করে।
পটভূমি: ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইরান সমর্থিত হামাস দক্ষিণ ইসরায়েলে একটি হামলা চালায়, যার ফলে ১২০০ জন লোক মারা যায়। ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু করে এর প্রতিক্রিয়া জানায়। হামাস পরিচালিত গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এ পর্যন্ত ৩৩ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এই সময়ে ইরান ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যা করার জন্য ইসরাইলকে অভিযুক্ত করেছে। গত বছরের ৭ অক্টোবরের পরে লেবাননের ইরান-সমর্থিত প্রক্সি হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরায়েলে আক্রমণ শুরু করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলের মধ্যে ৪৪০০ টিরও বেশি সহিংস ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে এবং সংঘাতের শুরু থেকে প্রায় ১ লক্ষ ইসরায়েলীয়কে উত্তর ইসরায়েল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
২০২৪ সালের ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি দূতাবাস সংলগ্ন ইরানি কনস্যুলেট অ্যানেক্স ভবনটি ইসরায়েলি বিমান হামলায় আঘাত হানে। এতে ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর (আইআরজিসি) একজন সিনিয়র কুদস ফোর্সের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং অন্যান্য সাতজন আইআরজিসি অফিসারসহ ১৬ জন নিহত হন। হামলার পরপরই ইরান প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রতিবেদনে এটিকে বিমান হামলার সম্ভাব্য উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরান দাবি করেছে যে, ভবনটি দূতাবাসের কম্পাউন্ডের অংশ ছিল, যখন ইসরায়েল দাবি করে যে, এটি ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী দ্বারা ব্যবহৃত একটি ভবন এবং দূতাবাসের বেড়াযুক্ত প্রাঙ্গণের বাইরে অবস্থিত ছিল। অসংখ্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এই হামলার নিন্দা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়িত থাকার বা অবগত থাকার বিষয় অস্বীকার করেছে।
হামলার আগের সপ্তাহগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্য সবাই ইরানকে ইসরায়েলে আক্রমণ না করার জন্য সতর্ক করেছিল, এই বলে যে, এই ধরনের আক্রমণ দীর্ঘতরই হবে এবং ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের সামরিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানকে সতর্ক করা হয়েছিল যে, এই ধরনের হামলা ইরানের মাটিতে সরাসরি ইসরায়েলি সামরিক জবাব দিতে পারে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান এবং কুয়েত এ কথা জানিয়েছে [কার মতে?] ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য হামলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের ভূখণ্ডে ঘাঁটি ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিলের শুরুতে ইরান হুমকি দিয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষা করতে হস্তক্ষেপ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করবে।
ঘটনাপ্রবাহ: ২০২৪ সালের ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরান একটি বিশাল ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ওয়াশিংটন পোস্ট এবং ইরানের সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ অনুসারে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত এই হামলায় ২০০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন ছিল। প্রকাশিত কিছু ভিডিওতে শাহেদ ১৩৬ ড্রোন ব্যবহারের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আমেরিকান কর্মকর্তা এবং ইসরায়েলি চ্যানেল ১২-এর মতে, মার্কিন এবং ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান একটি অনির্দিষ্ট সংখ্যক ইরানি ড্রোনগুলো করে ভ‚পাতিত করেছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বেনামী ফরাসি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে যে, ফ্রান্স ইসরায়েলকে সহায়তা করার জন্য নৌ সম্পদ মোতায়েন করছে।
প্রাথমিক প্রতিবেদন: আক্রমণের প্রথম দিকে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা অনুমান করেছিলেন যে, প্রায় ১০০টি ড্রোন চালু করা হয়েছিল। [৬১] যখন একজন মার্কিন কর্মকর্তা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং ইয়েমেন থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হবে, যদিও বেশিরভাগ ইরান থেকে হবে। মিসাইলের উপস্থিতি সম্ভাব্য বলা হয়েছিল। আক্রমণটি যখন চলছে তখনো এবিসি নিউজ জানিয়েছে যে, ইসরায়েল বলেছে যে শুধু সামরিক স্থানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
১৪ এপ্রিল: হিজবুল্লাহ বলেছে যে, তারা ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভ‚মিতে একটি ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা সাইটে কয়েক ডজন গ্র্যাড রকেট নিক্ষেপ করেছে। স্থানীয় সময় মধ্যরাতের পরপরই এ হামলা চালানো হয় বলে জানিয়েছে দলটি। স্থানীয় সময় অনুসারে আনুমানিক রাত দুইটার দিকে জেরুজালেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। তখন বিমান হামলার সাইরেন ইসরায়েল, পশ্চিম তীর এবং মৃত সাগরজুড়ে বেজে ওঠে। বিস্ফোরণগুলো আয়রন ডোম বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দ্বারা বাধা ছিল কিনা তা অজানা। আল-আকসা মসজিদের ওপরে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। তেল আবিব এবং একটি পারমাণবিক স্থাপনা থাকা ডিমোনাকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল। একটি ১০ বছর বয়সী বেদুইন মেয়ে আরাদ এলাকায় একটি ইন্টারসেপশন থেকে শ্রাপনেল দ্বারা গুরুতরভাবে আহত হয় এবং একটি সাত বছর বয়সী মেয়ে গুরুতর আহত হয়। সংরক্ষিত এলাকায় যাওয়ার সময় বা উদ্বেগের জন্য কমপক্ষে ৩১ জন আহত হওয়ার জন্য চিকিৎসা করা হয়েছিল।
জর্ডানের রাজধানী আম্মানের বাসিন্দারা শহরের ওপরে আকাশে ঝলকানি দেখেছে। শহরের মারজুল হামাম এলাকায় বাসিন্দারা একটি বড় ড্রোনের অবশেষের চারপাশে জড় হয়েছিল যা আটকানো হয়েছিল।
তাসনিম নিউজ এজেন্সি অনুসারে, প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে একটি ছিল বিমানঘাঁটি যেখান থেকে ইসরায়েল ইরানের কনস্যুলেটে হামলা চালায়। অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের দক্ষিণে র্যামন এয়ারবেস। সূত্রটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাতের ভিডিও প্রকাশ করেছে। আইডিএফের মতে ইরান ১৭০টিরও বেশি ড্রোন, ৩০ এর অধিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১২০ এর অধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছে, যার মধ্যে ৯৯ ভাগ সফলভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে। আইডিএফ জেট বিমানগুলো হিজবুল্লাহর রাদওয়ান বাহিনীর অন্তর্গত দক্ষিণ লেবাননে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে।
প্রতিক্রিয়া: হামলার সময়ে আইডিএফ ক্ষেপণাস্ত্র নেভিগেশন ব্যাহত করতে ইলেকট্রনিক গাইডেন্স সিস্টেম জ্যাম করে। জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত বলেছেন যে, ইসরায়েল হামলার প্রতিশোধ নিলে ইরান শক্তিশালী এবং আরো দৃঢ় পদক্ষেপের সাথে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার জাতীয় নিরাপত্তা প্রশাসন সিচুয়েশন রুমে হামলার মূল্যায়ন করছেন। ইরাক, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, কুয়েত এবং ইসরায়েল সকলেই হামলার প্রতিক্রিয়ায় তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছিল, ইরানের আকাশসীমা শুধু ভিএফআর ফ্লাইটের জন্য বন্ধ ছিল। যদিও ইরাক, জর্ডান এবং ইসরায়েল শিগগিরই পুনরায় তাদের আকাশসীমা খুলে দেয়। মিশর তার বিমান প্রতিরক্ষাকে উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রেখেছে। মিডিয়া প্রতিবেদনের বিপরীতে, জর্ডান জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেনি। ইরান জর্ডানকে ইসরায়েলকে সম্ভাব্য সমর্থন প্রদানের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে। ইসরায়েলের ওপর ইরানি হামলাকে ‘বেপরোয়া’ বলে নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। কানাডাও এই হামলার নিন্দা করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে, তারা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাকে সমর্থন করবে। সৌদিআরব সংযমের আহ্বান জানিয়েছে এবং বলেছে যে, এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্ব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে নিতে হবে। হামলার সমর্থনে ইরানের শহরগুলোতে এবং গাজায় বিক্ষোভ শুরু হয়।
ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলায় যোগ দেবে না যুক্তরাষ্ট্র: হোয়াইট হাউস ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে যে, ইরানের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধমূলক হামলায় অংশ নেবে না যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তারা এই সতর্কতার কথা জানিয়েছেন। সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে হামলার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ইসরায়েলে রাতারাতি ৩০০ টিরও বেশি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার কথা জানিয়েছে তেহরান। তবে লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই প্রায় সব ক্ষেপণাস্ত্রই ভ‚পাতিত করেছে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রবাহিনী। এক্ষেত্রে জো বাইডেন ইসরায়েলকে যে কোনো পাল্টা জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। রোববার সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় প্রশাসনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন যে, মি. বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ‘খুব সাবধানে এবং কৌশলীভাবে চিন্তা করতে’ বলেছেন। কর্মকর্তারা আরো বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন বিশ্বাস করে যে, ইসরায়েল এর বিনিময়ে ‘সেরাটাই পেয়েছে’, যার শুরু হয়েছিল সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেট ভবনে হামলায় সিনিয়র ইরানি সামরিক কমান্ডারদের হত্যার মাধ্যমে। হামলায় ইসরায়েলের দিকে যখন একযোগে প্রায় ১০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে আসছিল সে তুমুল উত্তেজনার মাঝেই মি. বাইডেন এবং মি. নেতানিয়াহুর মধ্যে কথোপকথন হয়। ওই টেলিফোন আলাপে দুই নেতা ‘কীভাবে পরিস্থিতি প্রশমন করা যায় এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে ভাবা যায়, সে সম্পর্কে’ আলোচনা করেন। এই কর্মকর্তা অবশ্য বলতে রাজি হননি যে, হোয়াইট হাউস ইরানের এই প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে কি না। তারা শুধু জানিয়েছে যে, ‘ইসরায়েলিদের এই হিসাব নিকাশ করতে হবে’।
ইসরায়েলের ওপর ইরানের হামলার পর ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের বৈঠক শেষে টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলোতে জাতীয় নিরাপত্তা মুখপাত্র জন কারবি বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে যে, তারা বড় ধরনে সংঘাত এড়াতে চায়। প্রশাসনের শীর্ষ সূত্র জানিয়েছে, ক‚টনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ইরানে একই বার্তা পাঠানো হয়েছে। মি. কারবি এবং এর কর্মকর্তা উভয়েই বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষা করতে থাকবে, তবে ইসরায়েলের কোনো প্রতিক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তাদের এই অবস্থান নিয়ে কিছু মার্কিন আইন প্রণেতা এবং উভয় রাজনৈতিক দলের প্রাক্তন কর্মকর্তারা সমালোচনার করেছেন। ওহাইও রিপাবলিকান প্রতিনিধি মাইক টার্নার, যিনি হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি বলেছেন, মি. কারবি সংঘাত কমিয়ে আনার বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন, সেটা ভুল। এটি ইতোমধ্যেই বাড়ছে এবং প্রশাসনকে এর প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে।
জন বোল্টন, যিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি বলেছেন, ইসরায়েল যদি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ শুরু করে তবে যুক্তরাষ্ট্রের এর সাথে যোগ দেওয়া উচিত। ‘আমি মনে করি ইসরায়েল পুরোটা না হলেও, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির খুব উল্লেখযোগ্য অংশ ধ্বংস বা নিষ্ক্রিয় করতে পেরেছে। ‘সত্যি বলতে, ইসরায়েল যদি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রতিহত করতে প্রস্তুত থাকে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের সাথে যোগ দেওয়া উচিত হবে।’ ইসরায়েলে ইরানের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে, প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন বলেছেন যে, তারা ইসরায়েলের জন্য সামরিক সহায়তা পাস করতে ‘আবারো চেষ্টা করবে’।
ইস্ফাহানে ইসরাইয়েলের হামলা: ইসরাইয়েলের ওপর ইরানের আকস্মিক হামলার পর ইসরায়েল ইরানের ইস্ফাহান শহরে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। ইরান এ হামলাকে তেমন আমলে নেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে যে, নেতানিয়াহুর সরকার ইরানকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছে। তারা ইরানকে বলার চেষ্টা করেছে যে, ওই এলাকার সংবেদনশীল লক্ষ্যগুলোতে হামলা চালানোর ক্ষমতা ইসরায়েলের রয়েছে, যদিও এখনই সেরকম হামলা করা হচ্ছে না। ইরানি কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে ঘোষণা করেন যে, ইস্ফাহান প্রদেশের পরমাণু স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। ইরানের কাছে কোনো পারমানবিক অস্ত্র নেই। তারা পারমাণবিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য নয় বরং বেসামরিক কাজে পারমাণবিক কর্মসূচিকে কাজে লাগাচ্ছে। ইরানের মহাকাশ সংস্থার মুখপাত্র হোসেইন ডেলিরিয়ান বলেছেন যে, বেশ কয়েকটি ড্রোন সফলভাবে ভূপাতিত করা হয়েছে। সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খবর নাকচ করে দিয়েছেন ওই মুখপাত্র। ইরানের কয়েকটি গণমাধ্যম ইস্ফাহান বিমানবন্দর ও একটি সামরিক বিমানঘাঁটির কাছে তিনটি বিস্ফোরণের খবর দিয়েছে। রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ এবং যুক্তরাজ্য ও ন্যাটোর পারমাণবিক বাহিনীর সাবেক প্রধান হামিশ ডি ব্রেটন-গর্ডন বলেন, ইস্ফাহানকে নিশানা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর আশপাশে অনেকগুলো সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ইরান যেখানে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে বলে আমরা মনে করি, ক্ষেপণাস্ত্র হামলাটি তার খুব কাছেই হয়েছিল, তাই এটি খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। ইসরায়েলি হামলা তাদের সামর্থ্য ও উদ্দেশ্যের বহিঃপ্রকাশ বলে মত প্রকাশ করেছেন আরো অনেকে।