বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে দেশের পুঁজিবাজারে। গতকাল সোমবার লেনদেনে অংশ নেওয়া অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর কমেছে। এদিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৯ দশমিক ৮০ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৮৯৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। যা গত ৩৪ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাজারের এ অবস্থায় আতঙ্কগ্রস্ত পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেশ কয়েকটি কারণে বাজারের এ মন্দাবস্থা। চলতি মাসের জানুয়ারিতে ‘ফ্লোরপ্রাইস’ প্রত্যাহারের পর বাজারে সূচক ও লেনদেন দুই-ই বাড়তে থাকে। কিন্তু এ সময়ে ভালো কোম্পানির চেয়ে মন্দ কোম্পানির শেয়ারদরই বেশি বেড়েছে। এমনকি কারসাজি করে বন্ধ কোম্পানির শেয়ারদরও বাড়ানো হয়েছে। এখন এসব কোম্পানির শেয়ারের দরপতন হচ্ছে। এছাড়া বাজারে তারল্যসংকট রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা গুজব। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়িয়ে একটি চক্র বাজারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। এসব কারণে অনেক বিনিয়োগকারী আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করছেন।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলেছেন, আমরা শুধু বাজারের সূচক নিয়ে কথা বলি। কিন্তু আমাদের বাজারের লং টার্ম (দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা) প্রবলেম কী? এটা নিয়ে কি নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করছে? শেয়ার বাজারে ২০১০-এ বড় ধসের পর এখন ২০২৪ সাল। দীর্ঘ এ সময়ে বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে উল্লেখযোগ্য কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? গত এক যুগে কয়টা ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। ভালো কোম্পানি বাজারে না থাকলে বাজার টিকে থাকবে কীভাবে?
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গতকাল সূচকের উর্ধ্বমুখী ধারায় লেনদেন শুরু হলেও পরে ধীরে ধীরে সূচক কমতে থাকে। বেলা ১২টার পর থেকে বড় ধরনের দরপতন শুরু হয়। ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৬৯.৮০ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৮৯৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এর আগে ২০২১ সালের ২৫ মে এই সূচকের অবস্থান ছিল ৫ হাজার ৮৮৪ দশমিক ৭৮ পয়েন্ট। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই-৩০ সূচক ৮.৯৬ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৪২.৬২ পয়েন্টে ও ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক ১৩.৫৫ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২৮৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে টানা সাত কার্যদিবস শেয়ার বাজারে দরপতন হলো। আর শেষ ২৩ কার্যদিবসের মধ্যে ২০ কার্যদিবসেই দরপতন হয়েছে। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৪৮৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৫১৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সে হিসাবে লেনদেন কমেছে ২৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। দেশের প্রধান এই শেয়ার বাজারে গতকাল লেনদেনকৃত মোট ৩৯৬টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র ৩৪টির। কমেছে ৩৩০টির। আর অপরিবর্তিত রয়েছে ৩২টির দর।
অন্য বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ১৬১ পয়েন্ট। এই বাজারেও গতকাল অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর কমেছে। লেনদেনকৃত মোট ২২৭টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র ৪৬টির। কমেছে ১৫৭টির। আর অপরিবর্তিত রয়েছে ২৪টির দর।
বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজের বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন—ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহারের পর তারা নতুন করে বিনিয়োগ করেছিলেন কিন্তু বাজারের এ অবস্থায় তারা আবার লোকসানে পড়েছেন।
বাজারের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, সুদ হার বেড়েছে, ফলে মানুষ শেয়ার বাজারে না এসে ব্যাংকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ট্রেজারি বিল, বন্ডে বিনিয়োগ করলে ১১-১২ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। তাহলে ২-৩ শতাংশ রিটার্নের জন্য কেন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করবে মানুষ? ডিবিএ প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদের বাজারে ভালো কোম্পানি খুবই কম। ৪০-৫০টা ভালো স্টক দিয়ে তো বাজার সাসটেইন করা মুশকিল। তিনি বলেন, রেগুলেটর যদি ইনডেক্স (সূচক) নিয়ে থাকে তাহলে তো হবে না। আমাদের মার্কেটের লং টার্ম প্রবলেম কী? এ বিষয়ে রেগুলেটরকে নজর দিতে হবে।
ইনভেস্টইট অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের (আইএএমএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ এমরান হাসান বলেন, দেশে ভালো কোম্পানির ১০ শতাংশও বাজারে তালিকাভুক্ত নেই। আবার তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির আয় ভালো কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের সেভাবে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। তিনি বলেন, আইপিওতে আসার সময় একটি কোম্পানি যে আয় দেখায়, বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর তার সেই আয় কমে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা হতাশ।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বিশিষ্ট পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, গত কিছু দিনে অনেক মন্দ কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে। এমনকি বন্ধ কোম্পানির শেয়ারের দামও বেড়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ারদর এখন কমছে। ফলে বাজারে এ দরপতন। এছাড়া তারল্যসংকট রয়েছে বাজারে। তবে বাজার নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সূচক কমেছে, আবার বাড়বেও।
বাজারের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের শেয়ার বাজারে কোনো সমস্যা নেই। মানি মার্কেটে এফডিআরের সুদের হার বেড়েছে। ফলে কিছু টাকা শেয়ার বাজার থেকে মানি মার্কেটে চলে যাচ্ছে। তবে রেমিট্যান্স-প্রবাহ বাড়লেই বাজার ঠিক হয়ে যাবে। বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনলাইন প্ল্যাটফরমে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন বিষয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কিছু ভিত্তিহীন গুজব ও অসত্য তথ্য ছড়িয়ে কারসাজি চক্র বিনিয়োগকারীদের ভয় দেখাচ্ছে। তাদেরকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা হবে।