Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeসম্পাদকীয়নজরুল: বিপ্লবী এক প্রতিষ্ঠান

নজরুল: বিপ্লবী এক প্রতিষ্ঠান

নজরুল মানে দুই হাত বুকে বাঁধা প্রত্যয়ে উজ্জ্বল এক বিপ্লবীর ছবি। নজরুল মানে দুখু মিয়া। দুখু মিয়া শব্দটির সঙ্গে দুঃখের গভীর সম্পর্ক। কিন্তু নজরুল আমাদের দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত, কর্মজীবী জীবনের সঙ্গে মিশে মানব সমাজের সুমহান সত্য আবিষ্কার করে গেছেন।

চাঞ্চল্য আর উদ্দীপ্ত জীবনের জয়গান নজরুলের মতো আর কেউ গাইতে পারেনি। নজরুল সাহিত্য সৃষ্টির জন্য ধীমান, স্থির বা প্রতিষ্ঠার সুসজ্জিত ব্রত গ্রহণ করেননি। তিনি তাকিয়ে থেকেছেন জীবনের দিকে, জীবন তাকে দান করে গেছে সময়ের আগুন, সে সঙ্গে এই নশ্বর পৃথিবীকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার এক সুকঠিন অনুভব, যা কোনো ধ্যানীর পক্ষেও রপ্ত করা কঠিন। সে কারণেই নজরুল তার সৃষ্টির বেলায় এক মৌলিক কাব্যসাধক আর জীবনাচারে সাধারণের ভেতর অনন্যসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব, যাকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায় না।

নজরুল আমাদের আয়েশি জীবনের ঘুম পাড়ানি গান শোনাতে চাননি, তার সৃষ্টিসমুহ আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে উদগীরিত লাভার মতো আগুনে আচ্ছাদিত করেছে শোষিত ভূমি। যে ভূমিতে আজ দামী প্রস্তরের সুদীর্ঘ স্তর জমে গেছে। নজরুল যে সমাজ ভাঙার জন্য শব্দ, দ্রোহ, ছন্দ আর অন্তর জোড়া হাতুড়ি শাবল নিয়ে পাথর শ্রমিকের মতো জীবনের তিনটি দশক নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন সে সমাজ আমরা ভেঙেছি ঠিক কিন্তু আজ উৎপীড়িতের ভেতরই শোষকের জন্ম হয়েছে। আমরা নজরুলকে আমাদের অস্থিমজ্জায় ধারণ করতে চাইনি বরং বিশ্বায়নের আনন্দ, মুক্তবাজারের প্রশান্তি আর পুঁজিবাদের হল্লায় মেতে ভুল পথে এসে পড়েছি বহুদূর। তাই নজরুলের গভীর জীবনবোধ আর শক্তি-ঐশ্বর্যের দিকে না তাকিয়ে আমরা খুঁজি কাব্য আর গীতির প্রশান্তি, খুঁজি জীবনের চঞ্চল প্রেম উচ্ছল এক সহজ সমীকরণ। এখানে দাঁড়িয়ে আসলে নজরুলকে ধারণ করা যায় না।

কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। বহু বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে জাতি স্বাধীনতার লাল সূর্যটা ছিনিয়ে এনেছে তাদের জাতীয় জীবনে এমন একজন বিপ্লবীই হতে পারেন সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। সবচেয়ে বড় বাতিঘর। কিন্তু আমাদের জীবনটা নজরুলের মতো ঝঞ্ঝামুখর জীবনের গভীর সুড়ঙ্গে যেতে চায় না। মুক্তচিত্তের বিশাল বৃত্তটা আবিষ্কার করতে শেখায় না, বরং ঘুরে ফিরে আমরা এক ক্ষুদ্রায়তনেই স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে নিই, নজরুলকে ব্যর্থ করে তুলি। আমাদের কৈশোর-তারুণ্য সংক্ষিপ্ত গন্তব্যে পৌঁছে নিতে চায় স্বস্তির শ্বাস, আমাদের মধ্যবয়স ছুটি নিতে চায় ব্যস্তসমস্ত যান্ত্রিকতা থেকে। সে কারণেই আমরা নজরুলের তারুণ্যময় দুখু মিয়ার উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে, বার্ধক্যের নজরুলকে মুরুব্বীর আসনে রেখে ক্ষান্ত নিতে চাই জীবনের সীমাহীন সংগ্রামের পথ থেকে।

আজ কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯তম জন্মদিন। আমাদের জাতীয় কবি ও বিদ্রোহী কবি এই দুই কবি শব্দের কাছে সমগ্র নজরুল জীবন আড়ালে পড়ে যায়। যে জীবন ছুঁয়েছে ভারতবর্ষের সাধারণ জীবনের অজস্র অভিঘাত সেই জীবনের বৈচিত্র্য আমরা ছুঁতে পারি না। একজন মানুষ কখন ব্যতিক্রম এক জীবনসত্তার অধিকারী হন? যখন সাধারণের সঙ্গে তার জীবন পথের কোনো মিল থাকে না, সাহসিকতায়, দূরদর্শিতায়, নিষ্ঠায় বা মুক্তির নেশায়। নজরুল ছিলেন তেমনই একজন। বাল্য, কৈশোর বলে কিছু ছিল না এই মানুষটির। দৃষ্টি খুলেই যেন পেয়ে গেছেন অপরিসীম এক তারুণ্য। যেন সংগ্রামের এক গনগনে পথ তার সামনে উন্মুক্ত হয়ে ইশারায় ডাকতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তিনি। পৃথিবীতে এসে কয়েক বছর পেরুতেই তার কণ্ঠে মসজিদ থেকে ভেসে এসেছে আজানের ধ্বনি। মক্তবেই কোরআন, ইসলামী ধর্মতত্ত্বের পাঠ। জীবন যেন ডাকছে দীর্ঘকায় এক জীবনের কাছে, চলছে সেই প্রস্তুতি। নিম্নমাধ্যমিকে এসেই থেমে গেল পাঠ গ্রহণের সুযোগ। অভাব অনটনের মতো প্রাকৃতিক অসহযোগ। বাধ্য হয়েই শিখতে শিখতে শিক্ষক। ছাত্র হিসেবে শেখার চেয়ে উচ্চতর আরেক শিক্ষা শিক্ষক হিসেবে। প্রতিনিধিত্ব, নেতৃত্ব আর জীবন মনীষার গভীর জায়গাটি ছুঁয়ে ফেলা। বয়স দশে না পৌঁছতেই এমন ঘটনা তো ঘটে না কারো জীবনে।

পৃথিবীতে কেউ কেউ এমন থাকেন, যারা বিস্ময় মানব। তারা কোনো উদাহরণ নন। বলতেই হবে তারা সৃষ্টিকর্তার বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত। তাই কবরস্থানের খাদেম হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। জীবন-মৃত্যুর বাস্তবতা গ্রহণের সুযোগও এই সময়েই। জীবনের স্কুলগুলো বাইরে থেকে উপলব্ধ হয় না সহজে। কিন্তু এই পরিবেশেই তৈরি হন একজন নজরুল। ধর্মীয় শিষ্টাচার, ধর্মবোধ ও চেতনা তীক্ষ্ণ হতে হতেই ডাক দেয় রাঢ় অঞ্চলের পল্লী গানের দল। সৃষ্টিলীলা আর স্রষ্টা যখন মধ্যমনে দানা বাঁধছে, তখন গভীর হয়ে আসছে কাব্য, আসছে সত্য রচনার সুখ। তখনই সামনে হাজির সুরের এক ইন্দ্রজাল। লেটো গানের দলে গান, কবিতা আর অভিনয়। জীবন তো শুধু পেটপূর্তির জন্য খাদ্য অন্বেষণ নয়। জীবনের খাদ্য আরো ব্যাপকতায় ভরা। সাহিত্য তাকে টেনে ধরে। টেনে ধরে বাংলার পাশাপাশি সংস্কৃত চর্চা। আর ধর্মতত্ত্বের গভীর কৌতূহল। এবার হিন্দু ধর্মের পুরাণগুলোও আত্মস্থ হতে থাকে দিনের পর দিন। নিজের বোধের ভেতরই তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব আর সত্য অনুসন্ধানের পথটি উন্মুক্ত হয়ে যায়। এবার শুধু উচ্চারণের পালা। ভাড়ারে বাংলা, আরবী, ফার্সি, উর্দু, সংস্কৃত শব্দ, চিন্তায় অশান্ত সমকাল। তার মতো অস্ত্রধারী আর কে ? এই ভারতবর্ষের পথে তিনিই ফেলতে শুরু করলেন অচেনা আলো।

বয়স যখন মাত্র এগারো তখন লোটোর দলের অভিজ্ঞতা নেয়া শেষ। ওস্তাদ হিসেবেই ছেড়ে দিতে হলো সেই পথও। তারপর অল্পকিছুদিন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার চেষ্টা। ষষ্ঠ শ্রেণীতেই যবনিকা। আবার এক কবিদল পার করে খ্রিষ্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা তারপর আসানসোলের রুটির দোকান। জীবিকার সঙ্গে অন্ত:জীবনের সম্পর্ক কম। তাই রুটির দোকানের কাজের ভেতরে গুরুত্বের সঙ্গে চালু কাব্যসাধনা। এখান থেকে জীবনতরী আবার তাকে ভাসিয়ে নিয়ে এলো ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে। ১৯১৪ সালের কথা। ১৯১৫ সালে আবার সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণী। ১৯১৭ পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সঙ্গে বোঝাপড়া চললো।

তারপর সময় ঠেলে পাঠালো সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে। শক্তি, সাহস, চাঞ্চল্য আর তারুণ্যে ভরপুর ১৮ বছর বয়স। এরই মধ্যে জীবনের বহু পাঠ শেষে সেনাবাহিনীর সুশৃঙ্খল ফৌজি জীবন। এই ছকে বাঁধা জীবনের ভেতরও লেখালেখিই তার জীবনীশক্তির কেন্দ্র হয়ে থেকেছে। ১৯২০ এ সেনাজীবনের ইতি। শুরু হলো সাংবাদিক জীবন। তার কয়েক বছরের সাংবাদিতকতা জীবনকে বলা যেতে পারে যোগাযোগের জীবন, সে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সুবর্ণ অধ্যায়। তার একেকটি লেখনী একেকটি ‘ধূমকেতু। সেসময়ের পত্রিকা থেকে পত্রিকায় নজরুল এক বিপ্লবী সাংবাদিক, নজরুল এক বিদ্রোহী লেখক। ১৯২২ সালে ২৩ বছর বয়সেই লিখলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনপথে হয়ে উঠলেন পুরাদস্তুর রাজনীতিক। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। তিনি সশস্ত্রবিপ্লবের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের পতন নিশ্চিত করার পক্ষে ছিলেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে অসহযোগ আন্দোলন চালানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিপ্লবী পুরোধা মোজাফফর আহমেদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে তিনি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছেন। সে সঙ্গে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য সবসময় থেকেছেন উচ্চকণ্ঠ। তার কবিতা সমকালে রাজনৈতিক শ্লোগানে এক অনন্য শক্তি হিসেবে ধরা দেয়। তার চেতনা নিঃসৃত প্রতিটি বাক্য হয়ে ওঠে দরিদ্র, মেহনতি, শোষিত মানুষের সামনে তাকাবার একেকটি নিশানা।

নজরুল জীবনের সকল সৃষ্টি ও বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের বয়স মাত্র আড়াই থেকে তিন দশকের বেশি নয়। ৪৩ বছর বয়স থেকে তিনি শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় তার কর্মপথে অবিচল থাকতে পারেননি। কিন্তু তার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যে জীবনীশক্তির দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা শুধু এক কবির জীবন নয়, সে জীবন এক মানবমুক্তির দিশারির। নজরুলের শিক্ষা, চেতনা আর তারুণ্য মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের পথে শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবী জীবনের সঙ্গেই মিলে যায়। তার তারুণ্য আমাদের চিরন্তন শক্তি সাহসের ভিত্তি হয়ে থাকে। তাই নজরুল কবি নয় শুধু, বিপ্লবী এক প্রতিষ্ঠান। জন্মদিনে এই বিপ্লবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments