শাসনকাল যত দীর্ঘই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাসকদের অপমানজনক বিদায় নিতেই হয়। এখন থেকে ৪৫ বছর আগে ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ইরানের শাহানশাহ (বাদশাহদের বাদশাহ), আর্যমেহের (আর্য জাতির সূর্য) মোহাম্মদ রেজা পাহলবীকে গণবিপ্লবের মুখে পালাতে হয়েছিল। সাম্রাজ্যের শীর্ষ পদ এবং ততোধিক জাঁকজমকপূর্ণ উপাধি তাকে রক্ষা করতে পারেনি। তাকে পলায়নের পথ বেছে নিতে হয়েছিল। দীর্ঘ ৩৮ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে ইরান শাসন করেছেন তিনি। সন্দেহ নেই, দেশটির প্রভূত উন্নয়নও করেছিলেন। তার রাজত্বে ইরানের অর্থনীতি এশিয়ার সকল দেশের কাছে ঈর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। তিনি নিজেকে জনগণের পরম পূজনীয় ভাবতে ভালোবাসতেন।
তৃতীয় বিশ্বের সকল স্বেচ্ছাচারী শাসকের মতো রেজা শাহ পাহলবীও বিশ্বাস করতেন যে, তার দেশের গণতন্ত্র ইউরোপের যেকোনো দেশের গণতন্ত্রের চেয়ে সেরা। কিন্তু সত্য হলো, তার গণতন্ত্রে তাকে বা তার কর্মকাণ্ডকে নিয়ে কোনো সমালোচনা ও বিরোধিতার স্থান ছিল না। তার এ “গণতান্ত্রিক” অসহনশীলতার বলি হতে হয়েছিল দুই লক্ষাধিক ইরানিকে। তিনি তার বিশাল অনুগত সেনাবাহিনীকে সজ্জিত করেছিলেন অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে। ১৯৭৮ সালে তেহরানের ছাত্রদের বিদ্রোহ দমনে এই সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে সৈন্যরা। সহস্রাধিক ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ নিহত হয়।
কিন্তু বিদ্রোহ অবদমিত হওয়ার পরিবর্তে আরও প্রবল হয়ে উঠে। বিদ্রোহীরা তাদের নেতা হিসেবে বেছে নেয় পনেরো বছর যাবত ফ্রান্সে নির্বাচিত ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনিকে। তার একটাই আহ্বান ছিল, ইরান শাহের উৎখাত এবং তার দাসানুদাসে পরিণত হওয়া প্রশাসনের সকলের পদত্যাগ। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ধেয়ে যেতে থাকে ইরান শাহের প্রাসাদের দিকে। তেহরানের সামান্য উত্তরে ‘নিয়াভরন প্রাসাদ’ নামে তার আবাসের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। এখানেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান, বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রেজা শাহ পাহলবী ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তেহরান বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ বিমানে আরোহণের জন্য প্রাসাদ থেকে শেষবারের মতো হেলিকপ্টারে উঠেন। ‘শাহীন’ নামে একটি ৭০৭ বোয়িং বিমানে আরোহণের আগে তিনি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে পার্লামেন্ট কর্তৃক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ারকে বলেন, “আমি খুব ক্লান্ত!” মৃত্যু পর্যন্ত তার এ ক্লান্তি আর ঘোচেনি।
ইরান শাহ জানতেন না, তিনি আর ইরানে ফিরে আসতে পারবেন না। ইরান থেকে তার পলায়নের সাথে অবসান ঘটে ইরানের আড়াই হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক শাসন। তিনি এটাও জানতেন না যে, স্বদেশের মাটিতে সমাহিত হওয়ার অধিকারটুকুও তিনি হারিয়েছেন। কিন্তু তখনও ইরানে তার কিছু ভক্ত-অনুরক্ত ছিল। সাংবাদিকদের তারা বলেছেন, “আমরা একটি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছি, কিন্তু যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।” কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ৪৫ বছরে তার বংশধরদের পক্ষেও কেউ আর লড়তে ও মরতে আসেনি। তার রেখে যাওয়া অন্তর্বর্তী সরকার দুই সপ্তাহের মধ্যে ভেঙে যাওয়ার সাথে তার ইরানে ফিরে যাওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে যায়। যেহেতু তিনি ছিলেন স্বঘোষিত “বাদশাহদের বাদশাহ,” তিনি তার শাসনকে অপশাসন ভাবেননি, লক্ষ মৃত্যুর জন্য দায়ী হলেও একটি বারের জন্য অনুশোচনা করেননি। জনগণের কাছে ক্ষমাও চাননি।
পলাতক শাহ রেজা পাহলবীর গন্তব্য ছিল অনিশ্চিত। শাহকে আশ্রয় দিয়ে কোনো দেশের সরকার ইরানে তার স্বৈরাচারী শাসন, জনগণকে অধিকার বঞ্চিত করা, বিরোধী কণ্ঠ চেপে ধরা, হত্যা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গকে নিজ দেশের সীমান্তে আনতে ইচ্ছুক ছিল না। তাকে অস্বস্তির সঙ্গে আশ্রয় দেয় আরেক একনায়ক মিশরের আনোয়ার সাদাত। কিন্তু রাজধানী কায়রো থেকে দূরে আসওয়ানে। এরপর তিনি যান জর্দানে, জর্দান থেকে মরক্কোতে।
তিনি তার দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু আমেরিকায় যেতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু আমেরিকাও তাকে আশ্রয় দিতে অস্বস্তি বোধ করে। নিতান্ত বাধ্য হয়ে তাকে বাহামায় অবস্থানের অনুমতি দেয়। ইতোমধ্যে ছাত্ররা তেহরানে আমেরিকান দূতাবাস দখল করে ৬১জন দূতাবাস কর্মীকে জিম্মি করে। এ পরিস্থিতিতে আমেরিকার পক্ষে শাহকে আর মূল ভূখণ্ডে আশ্রয় দেওয়ার ঝুঁকি গ্রহণ করা সহজ ছিল না। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে শাহের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে তাকে আমেরিকান তত্ত্বাবধানে মেক্সিকো পাঠানো হয়।
মেক্সিকোতে শাহের ক্যান্সারের চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকার শেষপর্যন্ত আমেরিকান সরকার তাকে নিউইয়র্কে চিকিৎসা গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে শাহ তার প্রাইভেট জেটে নিউইয়র্কে আসেন। চিকিৎসা চলাকালেই আমেরিকান কর্তৃপক্ষ তাদের অনুগত বন্ধু শাহকে জানিয়ে দেয় যে, ইরান ও আমেরিকার সম্পর্কের উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত আমেরিকার বাইরে অবস্থান করেই তার চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। এ প্রস্তাব শাহের জন্য চরম অসম্মানজনক ছিল।
তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পানামায় যান। খোমেনির অনুগত প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে পানামায় হত্যা করা হতে পারে আশঙ্কা করে তিনি চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা না করে গোপনে চলে যান মরক্কোয়। সেখান থেকে যান মিশরে আনোয়ার সাদাতের আতিথ্য গ্রহণ করতে। তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। ১৯৮০ সালের ২৭ জুলাই তিনি মারা যান। কায়রোর আল-রিফাই মসজিদ প্রাঙ্গণে কবরস্থ করা হয়। তার পলাতক পিতা পহ্লবি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রেজা শাহও দক্ষিণ আফ্রিকায় পলাতক জীবন কাটিয়ে ১৯৪৪ সালে জোহানেসবার্গে মারা যান। তার মরদেহ প্রথমে আল-রিফাই মসজিদ প্রাঙ্গণে কবরস্থ করা হয়েছিল। ১৯৫০ সালে তার দেহাবশেষ কায়রো থেকে তেহরানে এনে ‘রে’ শহরে কবর দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর তার দেহাবশেষ আবারও পাঠিয়ে দেওয়া হয় কায়রোতে তার সাবেক কবরে স্থাপন করার জন্য।
ইরানের পহ্লবি রাজবংশ টিকে ছিল মাত্র ৫৪ বছর। ১৯২৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। এ বংশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন মাত্র দু’জন শাসক। দু’জনকেই দেশ থেকে পালাতে হয়েছে এবং আশ্রয়ের জন্য দেশে দেশে ঘুরতে হয়েছে। তাদের সাবেক মিত্রেরাও তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে নিজেদের দেশে রাজনৈতিক ঝামেলা সৃষ্টি করতে চাননি। দু’জন শাসকই বিদেশে মারা গেছেন এবং নিজ দেশের মাটিতে সমাহিত হতে পারেনি।
দেশে দেশে স্বৈরশাসকদের এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশের শাসক নিজেদের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী করার লোভ সামলাতে পারেন না। তারা তাদের দু:শাসনকেও সুশাসন ভাবেন। জনগণের ধূমায়িত ক্ষোভকে ভাবেন দেশদ্রোহিতা এবং কঠোর হাতে দ্রোহ দমাতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। অবশেষে জীবন রক্ষার জন্য তারা পলায়ন করেন। জনগণ তাদের পলায়নকে মহা-উল্লাসে উদ্যাপন করে।