Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeআন্তর্জাতিকপ্রেসিডেন্ট হিসাবে আমেরিকানরা ট্রাম্পকে কেন বেছে নিলেন !

প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমেরিকানরা ট্রাম্পকে কেন বেছে নিলেন !

জয় বাংলাদেশ : রীতিমতো ইতিহাস গড়ে-ই হোয়াইট হাউসে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের শুরুতে বীর দর্পে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে পা রাখবেন যুক্তরাষ্ট্রেরই এই ঘটনঅঘটন পটিয়সী নেতা। এর আগে একবারই এ রকম ইতিহাসের অক্ষরে নিজের নাম খোদাই করেছিলেন গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড। ১৮৮৪ সালে জয়ী হওয়ার পর ১৮৮৮ সালে হেরে যান এবং ১৮৯২ সালের মার্কিন নির্বাচনে আবারও জয়ী হয়েছিলেন তিনি।

একইভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে একবার বিজিত এরপর ২০২৪ সালের নির্বাচনে আবারও জয়ী হয়ে ফিরে এলেন মসনদে। ইতিহাসের শিলালিপিতে খোদিত হলো একটি নাম–‘ট্রাম্প’।

এরই মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, তিনি কোনো ঝামেলা করবেন না, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। কারণ, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ‘জনগণের রায়ই’ শেষ কথা ।

বলে রাখা ভাল আমেরিকার রাজনীতিতে ‘আনপ্রেডিকটেবল হিরো’ হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ‘ঐতিহাসিক ফেরা’ মোটেও সহজ ছিল না। তাঁর মাথার ওপরে চারটি ফৌজদারি মামলাসহ অসংখ্য মামলা। এসব মামলার মধ্যে ৩৪টি মামলায় আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। এমনকি পর্নস্টার স্টর্মি ড্যানিয়েলসের করা ঘুষের মমলাতেও দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। এই মামলায় আগামী ২৬ নভেম্বর আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে সাজার রায় ঘোষণার দিনও ধার্য রয়েছে।

এর আগে আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্ট ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হননি। এ ছাড়া লাগাতার যৌন কেলেঙ্কারি, ঘুষ, দুর্নীতি, নথি গায়েব, একরোখা, জেদি, বদমেজাজি, অভদ্র, দাঙ্গাকারী, বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী, ফ্যাসিস্টসহ অসংখ্য অভিযোগ তো তাকে ঘিরে আছেই তারপরও দমে যাননি ট্রাম্প। জনগণের সামনে গেছেন ভোট চাইতে। ভোটাররা ধারণা করেছিলেন , এত অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, তাঁর দিক থেকে অবশ্যম্ভাবীভাবেই মুখ ফিরিয়ে নেবে মার্কিন জনগণ। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটেনি। বরং নির্বাচনের ফলাফলে নিরঙ্কুশ সমর্থনই দেখা গেল তাঁর প্রতি।

এখন প্রশ্ন উঠছে, কী জাদুবলে ট্রাম্প এমন অসম্ভবকে সম্ভব করলেন?

নিবার্চনী ক্যাম্পেইন পর্যালোচনা কলে দেখা যায় ট্রাম্প যখন মানুষের সামনে গেছেন ভোট চাইতে, তখন ঘুরেফিরে কয়েকটি কথাই বলেছেন। যেমন–তিনি আমেরিকাকে আবার মহান করবেন, অভিবাসীদের পত্রপাঠ বিদায় করবেন, মূল্যস্ফীতি কমাবেন, দ্রব্যমূল্য নাগালের মধ্যে আনবেন, চাকরির নিশ্চয়তা দেবেন, বিদেশি পণ্যে শুল্ক বাড়াবেন আর ধনীদের কর কমাবেন, ইউক্রেন যুদ্ধ থামাবেন, ইত্যাদি। এসবই ছিল মূলত ট্রাম্পের হাতে যুদ্ধ জেতার অস্ত্র। শেষ পর্যন্ত এই সব অস্ত্রেই সফল হয়েছেন তিনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব অস্ত্র দাগিয়ে নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে নিলেন ট্রাম্প, প্রেসিডেন্ট হিসেবে সেসব অস্ত্রেই বধ হতে পারেন তিনি। তাদের মতে, জনতুষ্টিবাদী নেতা ট্রাম্প যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে গদিতে বসতে যাচ্ছেন, সেসব প্রতিশ্রুতিই তাঁর গলার কাঁটা হতে পারে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করা তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

প্রথমত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চড়া দাম নিয়ে নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত ছিল মার্কিন জনগণ। কিন্তু ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বাইডেন সেদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেননি। বরং ইউক্রেন ও ইসরায়েলে কোটি কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা পাঠিয়ে দেশের মূল্যস্ফীতির আগুনে আরও ঘি ঢেলেছেন। এই জায়গায় কার্যত কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের। ফলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতির দিকে ঝুঁকেছে সাধারণ মানুষ। তারা জীবনযাত্রা সহজ করতে চায়। চায় আর্থিক মুক্তি।

কিন্তু ট্রাম্পের জন্য এই আর্থিক মুক্তি এনে দেওয়া কি সহজ হবে? ট্রাম্প যদি সতর্কতার সঙ্গে আর্থিক খাত না সামলান, মূল্যস্ফীতির তির বরং আরও বিষাক্ত হয়ে তাঁকেই বিদ্ধ করতে পারে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বন্ড মার্কেট এরই মধ্যে জাতীয় ঋণে ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করেছে। বন্ডের ফলন তীব্রভাবে বেড়েছে। এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, বন্ধকী ঋণ বা হোম ইক্যুইটি লোন কিংবা গাড়ি কেনার জন্য ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

পর্যালোচনা বলছে, রিপাবলিকানরা মূল্যস্ফীতি কমানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তা তাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। তারা যদি তা মনে রাখে এবং ভোটারদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করতে চায়, তবে অবশ্যই বেগ পেতে হবে।

ট্রাম্পকে একই ধরনের বাধার মুখে পড়তে হবে লাখ লাখ অনিবন্ধিত অভিবাসীকে দেশছাড়া করতেও। কাজটি শুধু মুখের কথার মতো সহজ নয়। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও সুদীর্ঘ পরিকল্পনা দরকার। ট্রাম্পের সেই পরিকল্পনা আছে কী? তিনি অবশ্য কখনোই তাঁর পরিকল্পনার কথা প্রকাশ্যে বলেননি।

ট্রাম্প মার্কিন ডলারের আমদানিতে শুল্ক আরোপের কথা বারবার বলেছেন। কিন্তু কীভাবে তিনি ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানিতে শুল্ক আরোপ করবেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলেননি। এই অসাধ্য সাধনেও বৃহৎ পরিকল্পনা দরকার। ট্রাম্পের সেই পরিকল্পনার কথা এখনো জানা যায়নি।

সিএনএনের এক জরিপে অংশ নিয়ে ৬৭ শতাংশ মার্কিনি বলেছেন, অর্থনীতির অবস্থা খুব খারাপ। তারা এ থেকে উত্তরণ চান। কারণ, নিত্যপণ্য কিনতে ২০২১ সালের জানুয়ারির তুলনায় তাদের এখন ১ হাজার ১২০ ডলার বেশি খরচ করতে হচ্ছে। এই তথ্য মুডিস অ্যানালিটিক্সের।

অপর এক জরিপে জানা যাচ্ছে, অর্থনীতি নিয়ে অসন্তুষ্ট এই ভোটারের ৬৯ শতাংশই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। কারণ, অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে তিনিই একটু আশার আলো দেখিয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন, জীবনযাপনের ব্যয় তিনি নাগালের মধ্যে নিয়ে আসবেন।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মূল্যস্ফীতি কমানোর পাশাপাশি কর্মজীবী মানুষদের মজুরিও বাড়াতে হবে। খেয়ালি ট্রাম্প জীবনযাপনে এলমেলো হলেও এসব ক্ষেত্রে খুব চাতুর্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি পেনসিলভানিয়াসহ সকল শ্রমিক অধ্যুষিত অঙ্গরাজ্যে বক্তব্য দেওয়ার সময় মজুরি বা বেতন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কারণ এসব এলকার কর্মজীবী মানুষেরা জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে বেতনের সঙ্গতি খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

কিন্তু ট্রাম্প সত্যিকার অর্থেই শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে পারবেন কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। ঋণের ভারে জর্জরিত মার্কিন অর্থনীতির সেই সক্ষমতা কি আদৌ আছে?

ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতিগুলোর বেশির ভাগই যে ‘অশ্বডিম্ব’, তা এরই মধ্যে বলে দিয়েছে পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্স। মার্কিন এই থিংক ট্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্ক আরোপ এবং লাখ লাখ অভিবাসী বিতাড়ন করার যে প্রতিশ্রুতি ট্রাম্প দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করলে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে এবং প্রবৃদ্ধি দুর্বল হবে। বলাই বাহুল্য, এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং কর্মসংস্থান কমবে।

শুধু তাই নয়, পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্স এই বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, ২০২৬ সালের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে উঠে যেতে পারে। আর ২০২৮ সালের মধ্যে দ্রব্যমূল্য ২০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।

পিটারসন ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা বলেছেন, ট্রাম্প যে শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করেছেন, তা বাস্তবায়ন করলে প্রতিটি মার্কিন পরিবারের বছরে ব্যয় ২ হাজার ৬০০ ডলার বেড়ে যাবে।

খুচরা বিক্রেতাদের প্রতিনিধিত্বশীল বাণিজ্যিক গোষ্ঠী ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশন বলেছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনামাফিক পোশাক, খেলনা, আসবাবপত্র, গৃহস্থালীর যন্ত্রপাতি, পাদুকা ও ভ্রমণ‑সামগ্রীর ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করলে সমগ্র মার্কিন জনগোষ্ঠীর বার্ষিক ব্যয় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যেতে পারে।

সুতরাং ট্রাম্পের বেশির ভাগ প্রতিশ্রুতিই যে অবাস্তবায়নযোগ্য, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে ওয়েস্টউড ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা অংশীদার ড্যানিয়েল অ্যালপার্ট বলেন, ‘আমরা সম্ভবত আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি। অভ্যন্তরীণ পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে। বিপরীতে কমবে কর্মসংস্থান ও বেতন। সামগ্রিক চিত্রের কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।’

এমনকি ট্রাম্পের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত স্টিফেন মোর, তিনিও বলেছেন–‘রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের বিষয়টি ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আপনি যদি শুল্ক বাড়ান, অবশ্যই ‘‘টির ফর ট্যাট’’ পরিস্থিতিতে পড়বেন। অর্থাৎ, ইট মারলে পাটকেল আপনাকে খেতেই হবে।’

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের এসব মতামত থেকে সহজেই বোঝা যায়, লোকরঞ্জনবাদী তর্কবাগিশ ট্রাম্প বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফাঁকা বুলি ছুড়েছেন। তিনি নির্বাচনে জেতার জন্য যেসব ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছেন, সেগুলোই তাঁকে ধরাশয়ী করতে পারে।

তবে পৃথিবীর তাবৎ রাজনৈতিক নেতার মতো তিনিও যদি ভোটারদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে যান, তাহলে সমস্যার আঁচ তাঁকে খুব একটা স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি অন্ধ হয়ে দিব্যি চারটি বছর মসনদে কাটিয়ে দিতে পারবেন। তাতে প্রলয় বন্ধ হবে কিনা, তা অবশ্য বলা যাচ্ছে না।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments