জয় বাংলাদেশ :আরও একবার অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে ভারতের মণিপুর। চলমান সহিংসতার কারণে পূর্ব এবং পশ্চিমে পরবর্তী ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে। ইম্ফল পশ্চিম, ইম্ফল পূর্ব, বিষ্ণুপুর, থৌবাল, কাকচিং, কাংপোকপি এবং চূড়াচাঁদপুরে বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবাও।
রাজ্যের শিক্ষা দফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যে সমস্ত জেলায় রাকফিউ রয়েছে সেখানে ১৯শে নভেম্বর পর্যন্ত স্কুল, কলেজসহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
গত কয়েকদিন ধরে একাধিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বারে বারে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুর। সম্প্রতি এক কুকি নারীকে হত্যার অভিযোগ, সিআরপিএফ জওয়ানের গুলিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর ১০ জন কুকি যুবকের মৃত্যু, তারপর নারী-শিশু মিলিয়ে ছয়জনের (মেইতেই গোষ্ঠীর) অপহরণ এবং পরবর্তীতে নদী থেকে তাদের দেহ উদ্ধারকে কেন্দ্র করে সে রাজ্যে নতুনভাবে হিংসা ছড়িয়েছে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মাঝে মণিপুরে রাজনৈতিক টানাপোড়েনও তুঙ্গে।
শনিবার একাধিক মন্ত্রী ও বিধায়কের পদত্যাগ দাবি করে তাদের বাড়িতে হামলার ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। বিক্ষুব্ধদের মোকাবিলা করতে নামানো হয় বিপুল পুলিশ বাহিনী। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে।
মণিপুর পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ২৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর রোববার রাতে মেইতেই সম্প্রদায়ের ছয়জনকে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে জিরিবাম থানা এলাকার বাবুপাড়ায় ভাঙচুর চালায়। বিক্ষুব্ধদের একাংশের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাঁধলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এদিকে, রোববার মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছে কনরাড সাংমার নেতৃত্বাধীন ন্যাশানাল পিপলস পার্টি।
মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা বিজেপির ন্যশানাল প্রেসিডেন্ট জেপি নাড্ডাকে চিঠিতে মণিপুরের অবস্থার কথা জানিয়ে অভিযোগ তুলেছেন, এন বীরেন সিংয়ের সরকার তার রাজ্যের (মণিপুরের) পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে সোচ্চার হয়েছে বিরোধীরাও।
মণিপুরের বর্তমান অবস্থা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রোববার একটা উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন। এরপরই সোমবার জানানো হয়, রাষ্ট্ৰীয় অনুসন্ধান সংস্থা বা এনআইএ মণিপুরের সাম্প্রতিক তিনটে ঘটনার তদন্ত করবে যাকে কেন্দ্র করে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে ওই রাজ্যে।
সোমবারের পরিস্থিতি কেমন
কারফিউ জারি করার পর সোমবার সকাল থেকেই থমথমে পরিস্থিতি রয়েছে ইম্ফলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল উপস্থিতি দেখা গেছে। কড়া তল্লাশি চালানো হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। রাস্তা-ঘাটে যান চলাচল কম। কড়া তল্লাশির পরই যানবাহন যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। ওষুধের দোকান এবং জরুরি পরিষেবা বাদে অন্যান্য দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে কারফিউয়ের আওতায় থাকা অঞ্চলে। মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন এবং রাজ ভবনের বাইরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ইম্ফলের বাসিন্দা পি শরৎচন্দ্র রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। মেইতেই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এই অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার বলেন,মণিপুর আর নিরাপদ নেই। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। গত একবছর ধরে যা অবস্থা তাতে মানুষের আর প্রশাসনের প্রতিও আস্থা নেই ।
আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধর-পাকড়, কারফিউ, তল্লাশি, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই প্রায় হয় না। উত্তপ্ত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য এমন পদক্ষেপ বহু বছর ধরেই দেখে আসছি আমরা। এতে কিছুই লাভ হয়নি। মণিপুরের পরিস্থিতি আসলে সাংবিধানিক ব্যর্থতার কারণে বলেই আমি মনে করি।”
মেইতেইদের পরিস্থিতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মেইতেই গোষ্ঠীর মানুষ মোটেই নিরাপদ বোধ করছেন না কোথাও।”
অন্যদিকে, কুকি গোষ্ঠীর অভিযোগ, মেইতেই প্রধান অঞ্চলে তাদের নিশানা করা হচ্ছে। কুকি গোষ্ঠীর হাতজালহই হাওকিপ বলেন, “কুকিদের পরিস্থিতির কথা আদৌ কি কেউ ভাবছে? তাদের দেখলেই মারধর করা হচ্ছে, বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। হয় আশ্রয় কেন্দ্রে থাকছে, নয়ত অন্য কোথাও গা ঢাকা দিতে বাধ্য হচ্ছে।” একইসঙ্গে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।
হাওকিপ বলেন, “শান্তি কমিটি তৈরি করার কথা বলা হয়েছিল, কোথায় সেই কমিটি এবং কী করেছে তারা? যদি কিছুই করেই থাকে তাহলে এই পরিস্থিতি তৈরিই হতো না মণিপুরে। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের সরকার কী করছে? গত বছর থেকে মণিপুরে আগুন জ্বলছে।”
মন্ত্রী-বিধায়কদের বাড়িতে হামলা
গত কয়েকদিন ধরে মণিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। ইম্ফলে বেশ কয়েকজন বিধায়ক ও মন্ত্রীর বাড়িতে শনিবার হামলা চালানো হয়, বেশ কয়েকটা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় মন্ত্রী, বিধায়ক এবং তাদের পরিবারেরা কেউ বাড়িতে ছিলেন না। ইম্ফল পূর্ব জেলার লুয়াংশাংবামে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের পৈতৃক বাড়িতে হামলার অভিযোগও ওঠে।
মণিপুরের স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণমন্ত্রী সাপম রঞ্জন, বিজেপি বিধায়ক তথা মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের জামাই আরকে ইমোর বাড়িতেও আক্রমণ চালানো হয় বলে অভিযোগ।
জিরিবাম থেকে যে ছয়জনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে তার ন্যায় বিচার এবং অভিযুক্তদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার দাবি জানান বিক্ষুব্ধরা। এর পাশাপাশি বিধায়ক-মন্ত্রীদের পদত্যাগও দাবি করেন তারা।
মণিপুর বিধানসভায় ন্যাশনাল পিপলস পার্টির বিধায়ক শেখ নুরুল হাসান বলেন, “বিকেল চারটার দিকে আমার বাড়িতে ১০০-১৫০ জনের ভিড় হয়। আমি সবে দিল্লি এসেছি। জমায়েতের কয়েকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলি।”
“ওদের অভিযোগ, বর্তমান বিধায়ক-মন্ত্রী মণিপুরের পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না, তাই তাদের পদত্যাগ করা উচিৎ। আমি তাদের দাবি মেনে নিয়েছি। তাই তারা আমার বাড়িতে হামলা না চালিয়ে ফিরে যায়। আমি বলেছি, জনগণ যা বলবে আমি সেটাই করতে রাজি।”
কেন আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুর?
গত সাতই নভেম্বর রাজ্যের জিরিবামে কুকি গোষ্ঠীর এক নারীকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ। এই ঘটনার পর থেকে জিরিবামে লাগাতার সহিংসতা চলে আসছে।
গত ১১ই নভেম্বর জিরিবাম জেলায় সিআরপিএফ জওয়ানদের সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠীর গুলিবিনিময় হয়। ওই জেলার জাকুরাদোর এলাকায় সিআরপিএফ পোস্টে হামলা চালানো হয়। গুলি বিনিময়ে যে ১০ জন যুবকের মৃত্যু হয় তারা আদিবাসী এবং কুকি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই ঘটনার পর বিক্ষোভ দেখান কুকি গোষ্ঠীর মানুষ।
এই ঘটনার পর শান্তি বজায় রাখতে জিরিবাম জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়।
এনকাউন্টারের পরে বোরাবেকারা থানার কাছে একটি ত্রাণ শিবির থেকে মেইতেই সম্প্রদায়ের একই পরিবারের ছয় সদস্য নিখোঁজ হয়ে যান, এদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল। মেইতেই গোষ্ঠী এই ঘটনার জন্য কুকিদের দায়ী করেন। মণিপুরের বিভিন্ন অংশে নারীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন।
ঘটনার দিন পাঁচেক পর গত শুক্রবার জিরিমুক গ্রামের কাছে ত্রাণ শিবির থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নদীতে এক নারী ও দুই শিশুসহ তিনজনের দেহ পাওয়া যায়। এরপরই নতুন করে হিংসা দেখা দেয়। এরপর একে একে ছয়জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ময়নাতদন্ত না হওয়া পর্যন্ত এই দেহ নিখোঁজদেরই কি না তা বলা সম্ভব নয়। তবে স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, উদ্ধার হওয়া দেহ অপহৃত ব্যক্তিদের। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়, জনপ্রতিনিধিরাও বিক্ষুব্ধদের রোষের শিকার হন।
মণিপুরের অবস্থাকে কেন্দ্র করে সে রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছে কনরাড সাংমার নেতৃত্বাধীন ন্যাশানাল পিপলস পার্টি।
তবে তাদের এই পদক্ষেপ মণিপুরে বিজেপি সরকারের জন্য এই মুহূর্তে খুব একটা চিন্তার কারণ হবে না বলেই মনে করা হয়। কারণ মণিপুরে বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা রয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে বিজেপির উপর থেকে কোনও জোটসঙ্গীর সমর্থন তুলে নেওয়া এনডিএ সরকারের প্রতি ভালো ইঙ্গিত দেয় না বলেই বিশ্লেষকদের মত।
নাগাল্যান্ড প্রদেশ কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মণিপুরের অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, রাহুল গান্ধীও প্রধানমন্ত্রীকে অবিলম্বে মণিপুর সফরে যাওয়ার এবং সেখানে শান্তি ফেরানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে ওই রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে কেন্দ্র। মহারাষ্ট্রে ভোটপ্রচারের কর্মসূচি বাতিল করে দিল্লি ফিরে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রোববার রাতে এই পরিস্থিতি নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকও করেন তিনি। গতবছর থেকে বারে বারে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ওয়াকিবহাল মহল।
সে রাজ্যের প্রবীণ সাংবাদিক মায়ুম শর্মা বলেছেন, “সহিংসতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন ভয় রয়েছে তেমনই সরকারের প্রতি তীব্র ক্ষোভও তৈরি হয়েছে। সেই ক্ষোভ এখন প্রকাশ পাচ্ছে।”
সরকারের উপর চাপ বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার যা অবস্থা সেটা স্পষ্ট। এন বীরেন সিংয়ের সরকার যে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি সেটাও স্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রীর উপর পদত্যাগের চাপ বাড়ছে। অন্যান্য মন্ত্রী-বিধায়কদের উপরেও একই চাপ বাড়ছে। অনেকে চাপের মুখে পদত্যাগ করবেন বলেছেন কিন্তু কবে করেন বা আদৌ করেন কি না সেটা দেখার।”
রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। শর্মার কথায়, “এই রাজ্যে প্রয়োজনীয় পরিষেবা ব্যহত হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। পড়ুয়াদের পরীক্ষা রয়েছে ডিসেম্বর মাসে, এই মুহূর্তে মণিপুরের যা পরিস্থিতি তাতে, ছাত্র-ছাত্রীরা কী করে পড়াশোনা চালাবে? অনেক ছেলে-মেয়ে বাইরে পড়াশোনা করতে যায়। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হওয়ার কারণে তাদের টাকা পাঠাতে পারছে না। এইভাবে রাজ্য চলতে পারে না।”
এই বিষয়ে ফিলেম রোহন সিংয়ের সঙ্গে যিনি মেইতেই গোষ্ঠীর অধিকারের জন্য কাজ করেন। তিনি জানান,“যখন নারী এবং শিশুদের নিশানা করা হয় তখন বিষয়টা কোনও একটা গোষ্ঠীর মধ্যে আটকে থাকে না। যখন দু’জন কুকি নারীকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো হয়েছিল, আমি সবার আগে প্রতিবাদ করেছিলাম। যে ছয়জন মেইতেইকে নিশানা করা হয়েছে সেখানে তো শিশুদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি।”
“আমার সবচেয়ে অবাক লাগে রাজ্য সরকার কী করছে? তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম রাজ্য সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারছে না, তাহলে কেন্দ্র কেন নিশ্চুপ?”
পুরো বিষয়টাকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। সিং বলেছেন, “মণিপুরের পরিস্থিতি কিন্তু আর কুকি এবং মেইতেই গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মনুষ্যত্বের উপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে আর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এটা কিন্তু রাজনীতির সময় নয়, শান্তি ফেরানোর সময়।”
কুকি সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা করে এমন এক সংগঠনের পক্ষ থেকে হাতজালহই হাওকিপ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং এটা শুধুমাত্র মণিপুরে আবদ্ধ নেই। রাজ্যের বাইরেও কিন্তু কেউ নিরাপদ বোধ করছেন না। নারী ও শিশুদের হত্যার ঘটনা নিন্দনীয় কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে কুকি মেয়েরা হুমকি পাচ্ছে।”
“শুধু রাজ্যে না, অন্যত্র বসবাসকারী কুকি মেয়েদের সাবধানতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে। ছাত্রী এবং কর্মরত নারীরা আতঙ্কে রয়েছেন। এটা একটা বাঁচার মতো পরিবেশ?”
বর্তমান পরিস্থিতি
বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব জনজীবনে পড়েছে। রাস্তা-ঘাটে অতিরিক্ত পুলিশ এবং নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে কয়েকদিন। বহু এলাকায় দোকানবাজার বন্ধ রয়েছে। রোববার রাজ্যপাল এল আচার্যর সঙ্গে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। তার সঙ্গে ছিলেন ১৮ জন বিধায়ক।
এদিকে, ইম্ফলে পুলিশের ডিজি, নিরাপত্তা উপদেষ্টা-সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইস্তফার দাবিতে রাজভবনের দিকে রওয়ানা দেয় মণিপুরের স্কুল এবং কলেজের কিছু শিক্ষার্থী। এর পাশাপাশি আধাসামরিক বাহিনী প্রত্যাহার এবং নৈতিক কারণে ৫০ জন বিধায়কের পদত্যাগও দাবি করেন তারা। রাজভবনের সামনে অবস্থান বিক্ষোভও করেন।
ধনমঞ্জরি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বলেন, খাঁচায় থাকা আর ইম্ফলে থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই এই বার্তা বোঝানোর জন্য আমরা মিছিল করছি। কুকিরা জানিয়েছে তাদের কাছে যে অস্ত্র রয়েছে তা দিয়ে তারা ২০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করতে পারে। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অবিলম্বে হস্তক্ষেপের দাবি জানাচ্ছি। একইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দিয়ে ইউনিফায়েড কমান্ড জারি করার কথাও জানাচ্ছি।
অন্যদিকে, মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করেও সোচ্চার হয়েছেন অনেকেই। রোববার রাতে বহু নারী রাস্তায় নেমে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার ইস্তফা দাবি করেছেন। অন্যদিকে, কুকি সম্প্রদায় এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সহিংস সংঘর্ষে অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার চিন্তার কারণ বলেই পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ড্রোন ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার ড্রোন হামলা রুখতে অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে বলে পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে।
আইজিপি (ইন্টেলিজেন্স) কে বলেছেন, সাম্প্রতিক হামলায় ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। এই হামলা রুখতে অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ব্যবহার করছে পুলিশ। পরিস্থিতির কথা ভেবে রাজ্য পুলিশ আরও অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম এবং অ্যান্টি ড্রোন গান কেনার কথাও ভাবছে।
এদিকে, কুকিদের পক্ষ থেকে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কথা অস্বীকার করা হয়েছে। হাতজালহই হাওকিপ বলেন, কুকিদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। এতো টাকা কোথায় যে অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করবে? তাদের বিরুদ্ধে এই জাতীয় অভিযোগ তুলছে কিন্তু এই সম্প্রদায়ের এত মানুষ যে প্রাণ হারালেন সে বিষয়ে তো কেউ কিছু বলছে না!
ওই সম্প্রদায়ের এক সদস্য প্রিম ভাইপেই যিনি আসাম ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন বিবিসিকে বলেছেন, দরিদ্র কুকিদের কাছে এত আধুনিক অস্ত্র কোথা থেকে আসবে? যদি আমাদের কাছে অস্ত্রই থাকত তাহলে আমরা আমাদের ভিটে-মাটি ছেড়ে উদ্বাস্তুর মতো থাকতে বাধ্য হতাম? গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে আমার ভিটে-মাটি ছাড়তে বাধ্য হই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মণিপুরের এক বাসিন্দা আবার পাল্টা অভিযোগ করেছেন। তার কথায়, এখানে পরিস্থিতি যা তাতে রাস্তায় বের হওয়া দুষ্কর। কুকিদের সশস্ত্র সদস্যরা সর্বত্র হামলা চালাচ্ছে।
ওয়াকিবহাল মহল কী বলছে?
মণিপুরের সিনিয়র সাংবাদিক মায়ুম শর্মা বলেন, মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। রোববার রাতে প্রায় ৯০০ নারী রাস্তায় মশাল হাতে নেমে এসে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবিও করছেন। আজ ছাত্ররা পথে নেমেছে, অবস্থান বিক্ষোভ করছে।
পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রবীণ সাংবাদিক নিঙলুন হাংঘালও। তিনি বলেন, আমি এইমুহূর্তে আসামে রয়েছি। কিন্তু মণিপুরে আমার পরিচিতদের মুখে তাদের পরিস্থিতির কথা শুনেছি। বেশ উদ্বেগজনক অবস্থা। নতুনভাবে সহিংসতার ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে।
যে ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে সে বিষয়েও তারা পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছেন। তার মতে, সাম্প্রতিক ঘটনায় যে ধরনের অত্যাধুনিক হাতিয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে তা আশঙ্কাজনক। সাধারণত কুকিরা এমন হাতিয়ার ব্যবহার করে না। দুই সম্প্রদায়ের সশস্ত্র গোষ্ঠীকেই এই হাতিয়ার ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে যা আরও উদ্বেগজনক। প্রশ্ন হলো, কারা যোগাচ্ছে এই অস্ত্র।এই হাতিয়ারের পিছনে বড় কোনো শক্তি থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা করেছেন দু’জনেই।
মেইতেই আর কুকিদের মধ্যে কেন সংঘর্ষ?
মণিপুরের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিন্দু মেইতেই জনগোষ্ঠীর। এদের অনেকেই বৈষ্ণব। রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংষ তারাই। অন্যদিকে পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করেন যেসব নাগা এবং কুকি উপজাতির মানুষ, তাদের একটা বড় অংশ খ্রিস্টান। এরকম ৩৩ টি উপজাতি গোষ্ঠীর বসবাস রাজ্যের ৯০ শতাংশ পাহাড়ি অঞ্চলে।
গত কয়েক বছর ধরেই মেইতেইরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন যে তাদের তপশিলি উপজাতি (এসটি) হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করার জন্য।
ভারতে যে সব সম্প্রদায় ঐতিহাসিকভাবে সমান সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে- তাদেরকে এসটি শ্রেণিভুক্ত করে তাদের জন্য সরকারি চাকরি, কলেজে ভর্তি ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির আসন সংরক্ষণ করা হয়।
২০২৩ সালের মে মাসে মণিপুর হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে মেইতেই সম্প্রদায়ের দাবি বিবেচনার নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাজ্যের অন্য উপজাতিগুলোর মধ্যে এতে উদ্বেগ সৃষ্টি হয় যে মেইতেইদেরকে এসটি মর্যাদা দেওয়া হলে তাদের চাকরির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে।
আবার রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলগুলি, যেখানে উপজাতীয়দের বসবাস, সেখানে মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষ জায়গা জমি কিনতে পারেন না। তবে মেইতেইরা উপজাতি তালিকাভুক্ত হলে পার্বত্য অঞ্চল তারা দখল করে নেবে, এই আশঙ্কাও তৈরি হয় উপজাতিগুলির মনে।
মনিপুরের একজন অগ্রগণ্য মানবাধিকার কর্মী ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে নাম উল্লেখ করতে বারণ করে গত বছর বলেন, মেইতেইরা রাজনৈতিকভাবে খুবই ক্ষমতাশালী। কিন্তু নাগা এবং কুকিসহ উপজাতীয় মানুষ সংরক্ষণের কারণে এবং তাদের পিছনে খ্রিস্টান মিশনারিদের সহায়তার কারণে পড়াশোনা বলুন বা রাজ্যের ভেতর আর বাইরে চাকরির ক্ষেত্রে, খুব দ্রুত উন্নতি করে ফেলেছে মেইতেইদের তুলনায়। তাই মেইতেই মধ্যবিত্তদের একাংশ মনে করছিলেন যে তাদেরও সংরক্ষণের আওতায় আসা উচিত, যাতে তারাও উন্নতি করতে পারে।
গত বছর হাইকোর্টের নির্দেশের প্রতিবাদ জানাতে মণিপুরের অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ডাকা এক মিছিলে হাজার হাজার লোক যোগ দেয় মে মাসের তিন তারিখ। ওইসব মিছিলগুলির একটি হচ্ছিল উপজাতীয়দের এলাকা চূড়াচন্দ্রপুর জেলায়। সেখানেই তখন সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর থেকে চলছেই লাগাতার সংঘর্ষ।