জয় বাংলাদেশ: চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি এ আহ্বান জানান। এ বিষয়ে তিনি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে জাহিদ হোসেন বলেন, কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগটি এই অর্থবছরের বাজেটে দেওয়া আছে, সেটি বাতিল করা হোক। সর্বোচ্চ আয়করের সঙ্গে ৫ থেকে ১০ শতাংশ জরিমানা যোগ করে সীমিত সময়ের (৩ থেকে ৬ মাস) জন্য এই সুযোগ পুনর্বহাল করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পর তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। আগামী জুলাই থেকে এক বছরের জন্য কালোটাকা সাদা করার এই ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাজেটে বলা হয়েছে, নগদ টাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে বৈধ বা সাদা করা যাবে। একইভাবে জমি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনেও এলাকাভেদে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে টাকা সাদা করা যাবে। একেক এলাকার জন্য বর্গমিটার অনুসারে নির্দিষ্ট কর দিতে হবে।
দেশের আয়করের সর্বোচ্চ হার ২৫ শতাংশ। বিশ্লেষকদের অভিযোগ, কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মধ্যে সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অসৎ করদাতাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ শুধু সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে মানুষকে অসৎ হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়। তাঁর মতে, সর্বোচ্চ করহারের সঙ্গে জরিমানা দিয়ে সীমিত সময়ের জন্য এই সুযোগ রাখা উচিত। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে এই সুযোগ তিন থেকে ছয় মাস রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা যাবে না। অর্থাৎ আবাসন খাত বা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে ছাড় দেওয়া হবে, এমন নিয়ম রাখা যাবে না। নিয়ম হতে হবে সোজাসাপটা। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের ক্ষেত্রে এই সুযোগ দেওয়া যাবে না। যাঁরা সৎ পথে আয় করে আয়কর নথিতে তা প্রদর্শন করেননি, শুধু তাঁদের এই সুযোগ দেওয়া উচিত।
অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেনের মত, এই অর্থ দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে উদ্ধার করা উচিত। দুর্নীতি দমন আইনে যেসব পরিবর্তন এনে তা শিথিল করা হয়েছিল, সেগুলো বাতিল করতে হবে। কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তদন্তের জন্য পুলিশ বা র্যাবের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কমিশনকে তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের আমলেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এনবিআরের সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত দেশে সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের ১৫ বছরে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা সাদা হয়। আওয়ামী লীগের শেষ তিন মেয়াদে (২০০৯-২৩) প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা হয়।
জাহিদ হোসেন বলেন, তথ্য অধিকার আইনে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে, সেগুলোও বাতিল করতে হবে। সেটা হলে সংবাদমাধ্যমগুলোও ঠিকঠাক কাজ করতে পারবে। সেই সঙ্গে টিআইবি, সুজন বা সিপিডির মতো সংস্থাগুলোও কাজ করতে পারবে। এতে দুর্নীতি দমনের কাজে দুদকের সুবিধা হবে।
সেই সঙ্গে যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা পাচার হওয়া অবৈধ অর্থের খোঁজখবর রাখে, তাদের সঙ্গে কাজ করা দরকার বলে মত দেন জাহিদ হোসেন। তিনি আরও বলেন, গভর্নর অবশ্য বলেছেন, কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে।
এ ছাড়া দুদক, বিএফআইইউ ও রাজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা কার কী দায়িত্ব, তার সুনির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা উচিত বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।
২০০৬-০৭ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। প্রকাশ করা হয়েছিল সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা। তখন প্রায় ৩২ হাজার করদাতা ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা সাদা করেন। মূলত ভয়েই তখন প্রচুর মানুষ সুযোগটি নেন।