জয় বাংলাদেশ : ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু করে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত হাসিনা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক খাত থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা লুট করেছে এস আলম গ্রুপ। আর এই সময়ে পরিকল্পিতভাবে দেশের স্থিতিশীল ব্যাংকগুলোকে আর্থিকভাবে দুর্বল করে খাদের কিনারে পৌঁছে দিয়েছে। এ জন্য ব্যবহার করা হয়েছে রাষ্ট্রের প্রধান স্বৈরাচার শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে একাধিক রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে।
আর এই ধারাবাহিকতায় এস আলমের এভাবে ব্যাংক লুট নিয়ে যাতে কোনোভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মুখ খুলতে না পারেন বা পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্য কোনোভাবে গণমাধ্যমে না আসে সে জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর পলায়নকারী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ২০২৩ সালের ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেপিআই এলাকায় ডিজিএফআইয়ের অফিস বরাদ্দ দেন। শুধু দেশের বিতর্কিত এস আলম গ্রুপকে বাঁচাতে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে এই বরাদ্দ দেয়া হয় বলে সূত্র জানিয়েছে। একই সময়ে এস আলমের লুটপাটের তথ্য গণমাধ্যমে যাতে না আসে সে জন্য সাংবাদিকদের প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা দেন গভর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কমন সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট-১ (জেনারেল পেমেন্ট সেকশন) পরিচালক মো. মজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক সার্কুলারে ডিজিএফআইয়ের জন্য অফিস স্পেস বরাদ্দ প্রসঙ্গে বলা হয়, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে প্রধান কার্যালয়ের দ্বিতীয় সংলগ্নী ভবনের ছাদে উত্তর-পূর্বাংশে ৬০০ (২০ী৩০) বর্গফুট স্থান বরাদ্দ দেয়া হলো। সার্কুলারে তলার বিবরণে বলা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ তলা ভবনের ছাদ। যার অনুকূলে দেয়া হয় সদর দফতর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর, টিআইএইচডিটিসিবি (প্রজেক্ট) ঢাকা সেনানিবাস। সার্কুলারের মন্তব্যে বলা হয়, ডিজিএফআইয়ের ডিজিটাল ওয়াকিটকি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের নিমিত্ত রেডিও সরঞ্জামাদি কক্ষ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি সংবেদনশীল স্থানে গোয়েন্দা সংস্থার অফিস থাকায় এবং এদের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের নানা ধরনের হুমকি-ভীতি তৈরি করতেন ৫ আগস্টের বিপ্লবের পরে পলায়নকারী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এমনকি কোনো তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে কর্মকর্তাদেরকে ডেকে নিয়ে শারীরিক-মানসিকসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হতো। এ ছাড়া নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে সন্দেহ করে শরীরে তল্লাশিও চালাতেন। এভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রকদের নিয়ন্ত্রণ করে আর্থিক খাতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে এস আলম গ্রুপ।
এদিকে আর্থিক খাতের বড় বড় কেলেঙ্কারি ও অর্থ পাচারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সহায়তা করেছেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা রেজিমের পতনের পর পলায়নকারী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। আর এসব আর্থিক কেলেঙ্কারিতে গভর্নরকে সহযোগিতা বা বুদ্ধিদাতা ছিলেন বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার। অভিযোগ রয়েছে, নূরুন নাহার ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন কোটায়। পদ খালি হওয়ার ৯ মাস আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের বিশেষ তদবিরে কোনো ধরনের ইন্টারভিউ বা সিলেকশন বোর্ড বা সার্চ কমিটি ব্যতিরেকে তাকে ডেপুটি গভর্নরের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন অনিয়ম এবং এখনো স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের দোসরদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট (বলয়) তৈরি করেছেন। এই বলয়ে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায় এবং মো. আনোয়ারুল ইসলামসহ রয়েছেন পরিচালক নওশাদ মোস্তফা, ইস্তেকমাল হোসেন, যুগ্ম পরিচালক তানবীর এহসান শোভন, এ ইউ এম মান্না ভূঁইয়া, তৌফিকুর রহমানসহ কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপ। এদেরকে নিয়ে আর্থিক খাতে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ তার উপর হলেও এখনো বহাল তবিয়তে নূরুন নাহার।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ তলায় ডিজিএফআইয়ের অফিস রয়েছে। যার নিয়ন্ত্রণ বা ব্যাংকি খাতের নিয়ন্ত্রণ তাই এখনো এস আলমের হাতে বলে মত দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা। একই সঙ্গে এভাবে মাথার উপর গোয়েন্দা সংস্থা থাকায় কর্মকর্তাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে এবং তারা সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত বলে উল্লেখ করেন।
আর্থিক সেক্টরে ব্যাংকখেকো হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকসহ আটটি ব্যাংক দখল করেছিলেন স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে। আর তারই অংশ হিসেবে ফ্যাসিস্ট হাসিনার গত নির্বাচনের আগে ব্যাংক খাত অর্থ লুটে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়। ব্যাংক লুটের এই অর্থের কিছু অংশ গত নির্বাচনেও ব্যবহার করা হয়েছে বলেও জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ব্যাংক খাতের লুটাপাট বা অর্থ পাচার নিয়ে কথা বলতে না পারেন সে জন্যই সাবেক গভর্নর ও স্বৈরাচার হাসিনা বাংলাদেশ ব্যাংকে গোয়েন্দা সংস্থার অফিস স্থাপন করেন বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আর্থিক খাতের একাধিক বিশ্লেষক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে গোয়েন্দা সংস্থার অফিস বসানো সুযোগ নেই। তবে কেন করেছেন তা আগের সরকার এবং গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টরা ভালো বলতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম একটি দায়িত্ব হলো গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করা। জালিয়াতি, অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাংক খাতে মানুষের আস্থা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারকে একাধিক ব্যাংক দখল ও বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়ার অনুমতি দিয়ে দীর্ঘদিন সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনে ভেঙে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা নজিরবিহীনভাবে আট ব্যাংক ও দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের শেয়ার দখলে নেয়। আর এই অসাধ্য কাজটি সম্ভব হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারণে। মূলত বিশেষ অনুমতি দিয়ে এই পরিবারকে সহায়তা করেছে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের অফিস এ বিষয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমার জানা নেই বিষয়টি। তবে এটি হতে পারে না। ব্যাংকের মধ্যে অফিস রাখার কোনো নির্দেশনা হলে অবশ্যই অ্যাকশন নেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।