Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeসম্পাদকীয়বাঙালির সপ্তম ঋতুর গল্প

বাঙালির সপ্তম ঋতুর গল্প

২০০০ সালে প্রথম কথাটি মাথায় এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলেছিলাম চ্যানেল আই অনলাইনে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে অমর একুশে বইমেলাই আসলে ‘সপ্তম ঋতু’।

অন্যান্য ঋতুগুলো দুই মাসের হলেও এই ঋতু এক মাসের। অন্যসব ঋতুর সঙ্গে এই ঋতু মিশে আছে। এই ঋতু ছাড়া অন্য ঋতুগুলোর যেন প্রকাশ থাকে না।

জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে। আমরা কোনো ঋতুরই কূল-কিনারা খুঁজে পাই না। কিন্তু বইমেলার মৌসুমে সবকিছু খুঁজে পাওয়া যায়। এটি এক সরব সময়। এই সময়ে আমাদের অনেক কথা জমা হয়ে যায়। এই সময়ে সারা বছরের কথার ‘নোট’ আর ‘কয়েন’গুলো সহজে খরচও করা যায়।

বইমেলার ওপরে যে আকাশ থাকে সে আকাশের রং আলাদা। বইমেলায় যখন অসংখ্য মানুষ ঘুরে বেড়ায়, বইমেলার আকাশে তখন এক ঝাঁক পাখি উড়ে বেড়ায়। বইমেলা যখন ফেব্রুয়ারি শুরুর শীত ছোঁয় তখন যেকোনো ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় শীত নেই। যেখানে বেশি মানুষ থাকে, সেখানে উষ্ণতা আসে। মানুষের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা। বইমেলায় অগণিত মানুষের উষ্ণতার ভেতর কবিতা থাকে। গল্প থাকে। ছন্দ থাকে। উচ্ছ্বাস থাকে। শিহরণ থাকে।

আগেকার বইমেলার যে মগ্নতা ছিল, তা এখন অন্যরকম। এখন বইমেলা বিশাল এক পরিসরে। আমরা মাঝে মাঝে বলি, বৃহত্তর বইমেলা। এই বৃহত্তর বইমেলার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা স্তম্ভ। আকাশ ছোঁয়া কাঁচের ঘর। তার নীচে সরোবর। কাঁচের ঘরটি পানির মধ্যে নড়তে থাকে।

একদল শিশু ভরা বইমেলায় ওই পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করে। এসব নিয়ে এক জীবন্ত ভাষ্কর্য তৈরি হয়। পানির মধ্যে একদল পথশিশুর জীবন্ত ভাষ্কর্য। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এমন পথশিশু পাওয়া যায় না। ওইসব দেশে এমন শিল্প মূর্ত করে তুলতে হাজার হাজার ডলারের প্রয়োজন হতো।

বইমেলার সন্ধ্যাটা অন্যরকম। যারা দুপুর-বিকেলে বইমেলায় ঢুকে পড়েন, সন্ধ্যা নাগাদ তারা জমে ওঠেন বইমেলার বিবিধ মুগ্ধতায়। তখন তাদের শরীর যে কথা বলে, মাথা সেকথা বলে না। মাথা তখন শব্দ-বাক্য, রং-রূপ, আনন্দ-উচ্ছ্বলতায় মগ্ন হতে থাকে। মনে হয়, আরো কিছুটা সময় থাকা যাক। অথবা বের হবার রাস্তাটির দিকে এগোনো যাক।

এই এগোনোর যে দ্রুতি ও সরণ তা পুরোপুরি ভিন্ন। কিছুদূর যেতেই কোথাও চোখ আটকে যায়, সেখানে কিছুটা সময়। তারপর আবার কিছুটা পথ। দেখা হয়ে যায়, প্রিয় কারোর সঙ্গে। বহুদিনের প্রিয়, বহুদিন পর দেখা। বহু জমানো কথা, তখন কবিতার পংক্তি হয়ে উঠতে থাকে। কথায় কথায় কবিতা হয়। কথায় কথায় গল্প হয়। তখন মনে হয়, যাক না আরো কিছ্টুা সময়।

বইমেলা মানুষের স্বাদ পাল্টে দেয়। ভালো চায়ের স্বাদ যেমন ভালো লাগে, খারাপ চায়ের স্বাদও ভালো লাগে এখানে। বই আসরে যে কোনো খাবার, তা সে চকলেট, পপকর্ণ যাই হোক অন্যরকম লাগে। পলিথিন খুলে বড় এক হাওয়াই মিঠাই টেনে ছিড়ে খেতে ভালো লাগে, গলায় কিঞ্চিত ঠান্ডা নিয়েও বইমেলার গেটে পসরা সজানো লেবুজল অমৃতের মতো লাগে। বইমেলার বাদাম সিংহভাগ পচা হলেও তার এক আলাদা স্বাদ পাওয়া যায়।

বইমেলায় প্রতিবছর ধুলো ওড়ে। এখানে ধুলিঝড় হয় না। ফাগুনের দায় আছে কিছুটা এর জন্য। বাতাসে আদ্রতা কমে যায়, মাটি রুক্ষ হয়ে ধুলো ছাড়তে থাকে। কিন্তু এই ধুলোকে বেশিক্ষণ খারাপ চোখে দেখা যায় না। দুপুরে যেই ধুলোকে খারাপ বলি, বিকেল গড়ালেই সেই ধুলো মিশে যায় আলো আঁধারির মগ্নতায়। তখন এই ধুলো মানুষকে ভুলিয়ে রাখে বইয়ের ভেতর। ধুলোর গন্ধহীনতায় কিঞ্চিত মিশে যায় বইয়ের ঘ্রাণ, তখন ধুলোময় বইয়ের রাজ্য, হার মানায় অন্য যেকোনো রাজ্যকে। এই সব কিছুই বাঙালির সপ্তম ঋতুর গল্প। বইয়ের ঋতুর গল্প।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments