জয় বাংলাদেশ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ও তার পরদিন (৫ ও ৬ আগস্ট) রাজধানীর ১৩টি থানা ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রাথমিক হিসাবে এর মধ্যে শুধু ৬ থানায় পুড়ে গেছে ১ হাজার ২২৬টি মামলার নথি। এ ছাড়া আগুনে পুড়ে ৬টি থানায় প্রায় ১ হাজার ১০০টি মামলার আলামত নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অধীনে থানা রয়েছে ৫০টি। পুলিশ জানিয়েছে, এর মধ্যে ৫ ও ৬ আগস্ট ২১টি থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগুনে পুড়ে যায় ১৩ থানা। ওই থানাগুলো হলো মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, পল্টন, শেরেবাংলা নগর, শ্যামপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ভাটারা, ওয়ারী ও খিলক্ষেত থানা।
যাত্রাবাড়ী থানার মামলার নথি ও আলামতের সঙ্গে সেগুলো সংরক্ষিত থাকা কম্পিউটার পুড়ে যাওয়ায় মামলার নথি ও আলামত—কোনোটিরই তালিকা তৈরি করা যায়নি।
এর মধ্যে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, আদাবর, পল্টন ও ওয়ারী—এই ৬ থানায় আগুনে ১ হাজার ২২৬টি মামলার নথিপত্র পুড়ে গেছে বলে প্রাথমিক হিসাবে পেয়েছে পুলিশ। বাকি যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, ভাটারা, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, খিলগাঁও ও খিলক্ষেত থানার পোড়া নথিপত্রের তালিকা এখনো তৈরি করা হয়নি।
যেসব থানার নথি পোড়ার হিসাব পাওয়া গেছে সেগুলোর চারটি মিরপুর, বাড্ডা, আদাবর, ওয়ারী এবং শ্যামপুর ও শেরেবাংলা নগর থানার আলামত পোড়ার হিসাবও করা হয়েছে। এই ৬ থানায় ১ হাজার ১০০টি মামলার আলামত পুড়ে গেছে। নগরীর যাত্রাবাড়ী থানার মামলার নথি ও আলামতের সঙ্গে সেগুলো সংরক্ষিত থাকা কম্পিউটার পুড়ে যাওয়ায় মামলার নথি ও আলামত—কোনোটিরই তালিকা তৈরি করা যায়নি। আর ভাটারা, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, খিলক্ষেত ও খিলগাঁও থানার ওসিরা জানিয়েছেন, থানাগুলোয় লুট হওয়া, পোড়া বা ক্ষতিগ্রস্ত মামলার নথি ও আলামতের হিসাব করা হচ্ছে।
ডিএমপির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ডিএমপির যেসব থানার নথিপত্র ও আলামতের সংখ্যা জানা যায়নি, সেগুলোর তালিকা তৈরি করতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। ডিএমপির সদর দপ্তরের ক্রিমিনাল ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস) থেকেও তথ্য নেওয়া যেতে পারে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বলেন, যেসব মামলার নথিপত্র পুড়ে গেছে সেগুলো ডিএমপির সিডিএমএস থেকে নিয়ে তদন্ত করা হবে। আর যেসব আলামত পুড়ে গেছে বা লুট হয়েছে, সে বিষয়ে আদালতের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেবেন তিনি।
সিডিএমএসে ডিএমপির ৫০ থানার মামলাগুলোর তথ্য সংরক্ষিত আছে। তবে ডিএমপি সদর দপ্তরে মালখানা না থাকায় সেখানে থানাগুলোর আলামত রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই।
কোন থানায় কত ক্ষতি
রাজধানীর মিরপুর মডেল থানার পুলিশ জানিয়েছে, থানায় ৬৬০টি মামলার নথিপত্র এবং মালখানায় থাকা বিভিন্ন মামলার ২৩০টি আলামত পুড়ে গেছে। থানা ভবনে থাকা নিবন্ধন (রেজিস্টার) খাতাও পুড়ে গেছে। বিভিন্ন মামলার কেস ডকেট বা সিডি (সব নথিপত্র) পুড়ে গেছে। এই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন মামলার নথিপত্র নতুন করে তৈরি করতে সময় লাগবে। সে ক্ষেত্রে মামলার তদন্তে ব্যাঘাত ঘটবে। আর বিভিন্ন মামলার আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে লিখিতভাবে জানাবেন। প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে প্রতিবেদন দেওয়া হবে আদালতে।
পুলিশ সূত্র জানায়, আগুনে মোহাম্মদপুর থানার ৮৯টি মামলার নথি পুড়ে গেছে। তবে কতগুলো মামলার আলামত ছিল, তা জানতে পারেনি পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানার ওসি ইফতেখার আহমেদ বলেন, থানার সবগুলো নিবন্ধন খাতা পুড়ে যাওয়ায় কতগুলো মামলার আলামত লুট হয়েছে, পুড়ে গেছে বা ধ্বংস হয়েছে, সেই সংখ্যা জানা যায়নি।
আগুনে বাড্ডা থানায় ১৩৭টি মামলার নথি ও ১৬০টি মামলার আলামত পুড়ে গেছে। শেরেবাংলা নগর থানায় মামলার সব নথিপত্র এবং দেড় শর মতো আলামত পুড়ে গেছে। আলামত হিসেবে জব্দ করা মাদক, গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিলও নষ্ট হয়ে গেছে।
আদাবর থানায় ৭৬টি মামলার নথি এবং ১০০টি মামলার আলামত পুড়ে গেছে। পুড়ে গেছে নিবন্ধন খাতাও। এতে মামলার তদন্তে সমস্যা হবে বলে মনে করেন আদাবর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. নজরুল ইসলাম। আগুনে পল্টন থানার ১৯০টি মামলার নথিপত্র পুড়ে গেছে। থানার ওসি মোল্লা মো. খালিদ বলেন, থানার নিবন্ধন খাতা পুড়ে যাওয়ায় কতগুলো আলামত পুড়েছে, তা জানা যায়নি।
ওয়ারী থানার ৭৪টি মামলার নথি এবং ২১৫টি মামলার আলামত পুড়ে গেছে ও লুট হয়ে গেছে। শ্যামপুর থানায় পুড়ে গেছে বা লুট হয়েছে ২৩৯টি মামলার আলামত। থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যেসব মামলার নথি পুড়ে গেছে, সেগুলোর তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
যাত্রাবাড়ী থানায় দেওয়া আগুনে জিডি, মামলার নথি ও আলামত সব পুড়ে গেছে বা লুটপাট করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। থানার ওসি মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম বলেন, জিডি, মামলার নথিপত্র, আলামত ও থানার নিবন্ধন খাতা, সবই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব তথ্য সংরক্ষিত থাকা কম্পিউটারও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে মোট মামলার সংখ্যা তিনি নিজেই জানেন না। এতে মামলার তদন্তে ব্যাঘাত ঘটবে। আদালত থেকে ও সিডিএমএস থেকে মামলার তথ্য নেওয়া গেলেও পুড়ে যাওয়া আলামত আর পাওয়া যাবে না।
সিডিএমএসে ডিএমপির ৫০ থানার মামলাগুলোর তথ্য সংরক্ষিত আছে। তবে ডিএমপি সদর দপ্তরে মালখানা না থাকায় সেখানে থানাগুলোর আলামত রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। ২০১২ সালে ডিএমপিতে সিডিএমএস চালু হয়েছে। এর আগের মামলাগুলো তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মামলার নথিপত্র পুড়ে যাওয়ায় তদন্তে সাময়িক বিঘ্ন ঘটবে বলে মনে করেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার নাইম আহমেদ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, এসব নথিপত্র সংশ্লিষ্ট সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) পদমর্যাদার কার্যালয় ও আদালতে সংরক্ষিত থাকে। সেখান থেকে তা সংগ্রহ করে মামলার স্বাভাবিক তদন্তকাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে।
প্রতিটি মামলার আলামত বিচারকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উল্লেখ করে পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু গণবিপ্লবে দেশের ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে, তাই সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মামলার আলামত নষ্ট বা ধ্বংস হয়েছে বলে আদালতকে জানাতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই আদালত মামলার বিচারকার্য চালাবেন এবং রায় ঘোষণা করবেন বলে তিনি মনে করেন।