Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeনিউইয়র্ক নিউজ৯/১১ হামলায় চতুর্থ উড়োজাহাজের লক্ষ্য আসলে যা ছিল

৯/১১ হামলায় চতুর্থ উড়োজাহাজের লক্ষ্য আসলে যা ছিল

জয় বাংলাদেশ: ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এ হামলা ৯/১১ নামে পরিচিত। ওই দিন আল-কায়েদার সন্ত্রাসীরা দুটি উড়োজাহাজ ছিনতাই করে নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের সুউচ্চ জোড়া ভবন বা টুইন টাওয়ারে হামলা চালায়। আরেকটি উড়োজাহাজ আছড়ে পড়ে পেন্টাগনে। হামলা হয় পেনসিলভেনিয়াতেও। এসব হামলায় প্রাণ যায় প্রায় ৩ হাজার মানুষের, আহত হন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই ইতিহাসের অন্যতম প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলা এটি।

ওই দিন প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীদের ছোট্ট একটি দল চারটি উড়োজাহাজ ছিনতাই করেছিল। এর মধ্যে নর্থ টাওয়ারে স্থানীয় সময় ৮টা ৪৬ মিনিটে ও সাউথ টাওয়ারে ৯টা ৩ মিনিটে আঘাত হানে দুটি উড়োজাহাজ। এতে ওই ভবনে আগুন ধরে যায়। অনেক মানুষ আটকা পড়েন। পুরো শহর ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে পড়ে। দুই ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ১১০ তলা ভবন মাটিতে ধসে পড়ে। ৯টা ৩৭ মিনিটে আরেকটি উড়োজাহাজ রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির মার্কিন সেনা সদর দপ্তরের বাইরে পেন্টাগনে বিধ্বস্ত হয়। ১০টা ৩ মিনিটে পেনসিলভানিয়ায় বিধ্বস্ত হয় চতুর্থ উড়োজাহাজটি। ধারণা করা হয়, ছিনতাইকারীরা ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপটিল ভবনে হামলা করতে চেয়েছিল। আবার অনেকে মনে করেন, ছিনতাইকারীদের লক্ষ্য ছিল হোয়াইট হাউস।

যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে ১০ সেপ্টেম্বর তীব্র ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। এতে পরিবেশ পরিষ্কার হয়। যাকে বলে উড্ডয়নের আদর্শ পরিবেশ। পাইলটরা কখনো কখনো একে সিভিয়ার ক্লিয়ার বা সিএভিইউ (সিলিং ও ভিজিবিলিটি সীমাহীন) বলে। এর পরের দিনটিই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলার জন্য আল-কায়েদার ১৯ জঙ্গির জন্য আদর্শ দিন হয়ে ওঠে।

১১ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ২৮ মিনিটে টুইন টাওয়ার হিসেবে পরিচিত বিশ্ব বাণিজ্যে কেন্দ্রে (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার) ছিনতাই হওয়া দুটি উড়োজাহাজ আঘাত হানার পর তৃতীয় আরেকটি উড়োজাহাজ আঘাত হানে পেন্টাগনে। এ সময় চারজন জঙ্গি ইউনাইটেড ফ্লাইট–৯৩–এর পাইলট ও তাঁর সহকারীকে দিক পরিবর্তন করায়।

ছিনতাইকারীদের মধ্যে একজনের উড়োজাহাজ চালানোর প্রশিক্ষণ ছিল। তাঁর নাম জিয়াদ জারা। তিনি উড়োজাহাজটিতে ৯টা ৫৫ মিনিটে পুরোপুরি ঘুরিয়ে নেন। এরপর তিনি রিগান ন্যাশনাল এয়ারপোর্টের নেভিগেশনাল কোডে ডায়াল করেন। কিন্তু তাঁর সেখানে অবতরণ করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনা বুঝতে পেরে দুই মিনিটের মধ্যে যাত্রীদের মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়। এরপরই ওই উড়োজাহাজটি শাঙ্কসভিলে বিধ্বস্ত হয়।

কিন্তু এই উড়োজাহাজে আসল লক্ষ্য কোনটি ছিল? ২৩ বছর পরে এসেও এখনো ৯/১১ হামলার চতুর্থ উড়োজাহাজটি ঘিরে রহস্য রয়ে গেছে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী হামলাসংক্রান্ত সর্বদলীয় জাতীয় কমিশনের প্রতিবেদনটিও নিষ্পত্তিহীন। এতে বলা হয়েছে, জারার লক্ষ্য ছিল বিমানটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতীক ক্যাপিটল হিল বা হোয়াইট হাউসে বিধ্বস্ত করা। যদিও ক্যাপিটল হিলই লক্ষ্যবস্তু ছিল বলে বেশিরভাগ মানুষ ধারণা করেন। তবে হোয়াইট হাউসও যে এর লক্ষ্যবস্তু হতে পারে, তা কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

ফ্লাইট–৯৩–কে অনেক সময় ৯/১১ হামলার চতুর্থ উড়োজাহাজ বলা হয়ে থাকে। এটির কথা পরে আসে। সব উড়োজাহাজের পর এটি যাত্রা করেছিল। অন্য উড়োজাহাজগুলোর মতো এটি লক্ষ্যে পৌঁছায়নি। এতে পাঁচজনের পরিবর্তে মাত্র চারজন ছিনতাইকারী ছিলেন। এ উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত না হলে ফ্লাইট ৯৩–এর আঘাতই হতো নাইন–ইলেভেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ, এতে মার্কিন নেতৃত্ব পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেত এবং গণতন্ত্রের দুর্গ চুরমার হতো।

নিউ জার্সির রিপাবলিকান পার্টির সাবেক গভর্নর টম কিন ৯/১১ কমিশনের সভাপতি ছিলেন। তাঁর ভাষ্য, ক্যাপিটল বা হোয়াইট হাউসে যদি আঘাত হানত, তবে তা দেশের জন্য শুধু বাহ্যিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও বিধ্বংসী হতো।

সন্ত্রাসীরা সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু নিউইয়র্ক এলাকার তিনটি প্রধান বিমানবন্দরে দীর্ঘস্থায়ী যানজটের কারণে তাদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। ফ্লাইট–৯৩ সকালের ভিড়ের সময় এয়ার ট্র্যাফিক বিলম্বের কারণে নিউইয়র্ক ইন্টারন্যাশনাল থেকে ২৫ মিনিট দেরিতে উড্ডয়ন করেছিল। এরপর অজানা কারণে ছিনতাইকারীদের আরও ৪৬ মিনিট দেরি করতে হয়। এই বিলম্বের কারণে যাত্রীরা এয়ারফোন কথোপকথনের মাধ্যমে অন্যান্য আক্রমণ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারে। তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁদের উড়োজাহাজ ছিনতাই হয়েছে এবং তাঁরা আত্মঘাতী মিশনে থাকা সন্ত্রাসীদের কবলে পড়েছেন।

এই উড়োজাহাজ পুনর্দখলের সম্ভাবনাও ছিল। ওই উড়োজাহাজে ৩৩ যাত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সাবেক অ্যাথলেট, ছোট উড়োজাহাজের চালক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তাও ছিলেন। যাত্রীরা যখন ককপিটে আক্রমণ করেন, তখন ছিনতাইকারী জারার হয় নিয়ন্ত্রণ হারান অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত করেন। তখনো লক্ষ্য ১২৫ কিলোমিটার দূরে ছিল। তখন ক্যাপিটল নাকি হোয়াইট হাউস তাঁর লক্ষ্য—তা আজও অজানা।

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, টুইন টাওয়ারে যখন উড়োজাহাজ হামলা চালানো হয়, তখন ভবনটিতে ১৭ হাজার ৪০০ মানুষ ছিলেন। নর্থ টাওয়ারে যেখানে হামলা হয়, সে স্থানের কেউই বাঁচতে পারেননি। কিন্তু ১৮ জন সাউথ টাওয়ারের ইমপ্যাক্ট জোনের ওপরের মেঝে থেকে বেঁচে যান। হতাহতদের মধ্যে ৭৭ দেশের মানুষ ছিলেন। নিউইয়র্ক নগরের ৪৪১ উদ্ধারকর্মী নিহত হন। হামলার পর হাজারো মানুষ আহত বা নানা রোগে আক্রান্ত হন। বিষাক্ত ধ্বংসস্তূপে কাজ করা অনেক অগ্নিনির্বাপণকর্মীও ছিলেন।

হামলায় ১৯ জঙ্গি

আফগানিস্তানের জঙ্গি সংগঠন আল–কায়েদা এ হামলার পরিকল্পনা করে। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দায়ী করে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মূল পরিকল্পনায় এ হামলা চালানো হয়। উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ে ১৯ জন যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের তিনটি দল ও চারজনের একটি দলে ভাগ হয়ে উড়োজাহাজ ছিনতাই করা হয়।

প্রতিটি দলে এমন একজন ছিলেন, যাঁর উড়োজাহাজ চালানোর প্রশিক্ষণ ছিল। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রেরই উড়োজাহাজ প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেন। এরমধ্যে ১৫ জন ছিলেন সৌদি আরবের নাগরিক। দুজন ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের, একজন মিসর এবং একজন লেবাননের।

টুইন টাওয়ারে হামলার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে আল–কায়েদাকে নিশ্চিহ্ন করতে আন্তর্জাতিক জোট হামলা চালায়। ওই সময় থেকে ওসামা বিন লাদেনের খোঁজ করা শুরু হয়। মার্কিন গোয়েন্দারা ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে তাঁর খোঁজ পায়। ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি বাংলোয় নেভি সিল কমান্ডো বাহিনীর ‘টিম সিক্স’-এর অভিযানে নিহত হয়েছিলেন ওসামা। এর আগে ২০০৩ সালে পাকিস্তানে গ্রেপ্তার হন ৯/১১ হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী খালিদ শেখ মোহাম্মদ। সাবেক আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের সবচেয়ে আস্থাভাজন ব্যক্তিদের একজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন খালিদ।

১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানে বিন লাদেনের পাশাপাশি লড়াই করেছেন খালিদ। তবে বিন লাদেনের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছে আরও ১০ বছর পর। তখন খালিদ যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পরিকল্পনা শুরু করেন। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালানো হয়।

খালিদকে গুয়ানতানামো বে কারাগারে আট বছর বিচারহীন অবস্থায় বন্দী করে রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত খালিদ শেখ মোহাম্মদের সঙ্গে গত মাসে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে পরে চুক্তিটি বাতিলের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। সম্ভাব্য মৃত্যুদণ্ড এড়াতে খালিদ ও তাঁর দুই সহযোগী কথিত ওই সমঝোতা চুক্তি করেছিলেন বলে শোনা যাচ্ছিল।

কিউবার গুয়ানতানামো ঘাঁটিতে বেশ কয়েক বছর ধরে খালিদ এবং দুই সহযোগীকে আটক রাখা হয়েছে। ৯/১১ আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে বিচারপূর্ব অবস্থায় আটকে আছে। ৯/১১ হামলার পরের বছরগুলোয় সিআইএর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন খালিদ এবং তাঁর সহযোগীরা। এখন সুষ্ঠুভাবে তাঁদের বিচার করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েই মূলত আইনি জটিলতা চলছে।

আল–কায়েদা নিশ্চিহ্ন হয়নি

ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পরও আল–কায়েদা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এখনো আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে আল–কায়েদার অবস্থান বেশ মজবুত। আফগানিস্তানের ভেতরেও আল–কায়েদার অস্তিত্ব রয়েছে।

প্রায় ২০ বছর আফগানিস্তানে অবস্থান করার পর এ বছর মার্কিন সেনারা দেশে ফিরেছে। এতে অনেকের আশঙ্কা, আবার জঙ্গি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠতে পারে।

৯/১১ ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে ফ্লাইটের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে উড়োজাহাজ ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়াতে ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি প্রশাসন সৃষ্টি করা হয়েছে। টুইন টাওয়ার যেখানে ধ্বংস হয়েছিল, সেটি পরে গ্রাউন্ড জিরো নামে পরিচিতি পায়। সেটি পরিষ্কার করতে আট মাস সময় লেগেছিল। সেখানে এখন একটি স্মারক ও জাদুঘর তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ভিন্ন নকশায় তৈরি হয়েছে নতুন ভবন।

ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা ফ্রিডম টাওয়ার নামে ভবনটি নর্থ টাওয়ারের চেয়েও উঁচু করে তৈরি করা হয়েছে। নর্থ টাওয়ারের উচ্চতা যেখানে ছিল ১ হাজার ৩৬৮ ফুট, সেখানে ফ্রিডম টাওয়ারের উচ্চতা ১ হাজার ৭৭৬ ফুট। পেন্টাগনে মেরামতকাজ করতে মাত্র এক বছর সময় লাগে। ২০০২ সালের আগস্ট মাসেই সেখানে কর্মীরা যোগ দেন।

 

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments