Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeমতামতআসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটারের গুরুত্ব

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটারের গুরুত্ব

জনসংখ্যাবহুল ও ক্ষুদ্রায়তন বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতি ও উন্নয়ন আজ বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয়। বিগত দুই দশক ধরে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক অগ্রগতির সব সূচকে বিশেষভাবে জিডিপির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষার প্রসার, নারীর ক্ষমতায়ন, শিল্পায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংস্থা আজ বাংলাদেশের অগ্রগতিকে ‘বিস্ময়কর’ বলে অভিহিত করছে। সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশের দ্রুত ধারাবাহিক আর্থসামাজিক অগ্রগতি ‘উদীয়মান অর্থনীতির দৃষ্টান্ত’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ আজ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ও বৈশ্বিক সংগঠন কর্তৃক তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য রোল মডেল হিসেবেও স্বীকৃতি পাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচক’-এ বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম। লন্ডনভিত্তিক একটি থিংক ট্যাংকের মতে, ২০৩৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৯১টি দেশের মধ্যে ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে।

তাই, দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র সুসংহত করার ক্ষেত্রে আসন্ন নির্বাচনে নতুন ভোটারদের অংশগ্রহণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাত্পর্যপূর্ণ। দেশের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়েনর অগ্রযাত্রায় ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়ন এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে সাফল্যের কেন্দ্রে রয়েছে নতুন ভোটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ, সংখ্যায় যা ৫ থেকে ৬ কোটি এবং জনসংখ্যার কাঠামোগত পরিবর্তনে যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষিত যুব বেকারত্ব রোধে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু প্রণীত নীতিমালা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা ও সদিচ্ছার অভাব তরুণ সমাজকে কিছুটা হলেও হতাশ করেছে। কিছু ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ফলস্বরূপ কিছু তরুণ নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়, আবার কেউ বিমানে চেপে উড়ে যায় ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়। একবার চলে গেলে তারা আর দেশে ফিরে আসে না। তবে যারা থেকে যায়, আসন্ন নির্বাচনে তারা গুরুত্বপূর্ণ। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এরকম নতুন ও তরুণ ভোটারের সংখ্যা ১ কোটি ৫৪ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৬। মোট ভোটার যেখানে প্রায় ১২ কোটি, সেখানে এই তরুণ ভোটারের সংখ্যা কম নয় বলে তারা অনুপেক্ষণীয়।

প্রথমত, নতুন ভোটাররা একটি উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করেন। তাদের সংখ্যা নির্বাচনের ফলাফল এবং রাজনৈতিক দলের নীতিগত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির গঠনমূলক সমন্বয় ঘটিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আলোচ্যসুচি নির্ধারণে নতুন ভোটারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের চারটি মূলনীতির একটি হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।’ দ্বিতীয়ত, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১’ বাস্তবায়নের প্রধান দিক হচ্ছে সব ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক পযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা তরুণদের বেশি। তৃতীয়ত, বিগত দশকে বাংলাদেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিটিআরসির তথ্যমতে, যেখানে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ৩১১৪০.৮০ হাজার জন, ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৬.৪৫ মিলিয়ন। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সুসংহতকরণ এবং রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট প্রদানের গুরুত্ব তুলে ধরে জনমত সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নতুন ভোটারদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

চতুর্থত, টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক চর্চার অন্যতম উপাদান রাজনৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা। এক্ষেত্রে নতুন ভোটাররা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সচেতনতা ও মূল্যবোধ রপ্ত করার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক নীতিসমূহ গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবে, যা পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন, লিঙ্গ সমতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে সমর্থনের মধ্য দিয়ে আরো ন্যায়সংগত সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পঞ্চমত, বর্তমানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হচ্ছে সুশাসন। সুশাসনের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং নাগরিক সেবা প্রদানে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। উদীয়মান শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে নতুন ভোটারদের জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত কল্যাণ বিবেচনায় তথাকথিত রাজনৈতিক স্বার্থে আবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তারা রাজনৈতিক প্রার্থী ও দলগুলোর কাছ থেকে বৃহত্তর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি দাবি করতে পারে, যা গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়ায় একটি স্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক পরিবেশ গঠনে কার্যকর। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ডিডব্লিউ একাডেমি ও আর্টিক্যাল নাইনটিন আয়োজিত “মাই ভয়েস ম্যাটার” শীর্ষক বিতর্ক ফোরামগুলোতে দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর আলোচনায় গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। উক্ত ফোরামে তরুণেরা বলেছেন, তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মত প্রকাশের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত ও নিরাপদ প্ল্যাটফরম প্রত্যাশা করে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে তারা তরুণ সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে চায়। বিশেষ করে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ও প্রত্যাশিত হারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি।

এছাড়া তরুণ ভোটাররা পরিচ্ছন্ন রাজনীতির জন্য দুর্নীতির চর্চা হ্রাস এবং আরো দক্ষ সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী দায়িত্ব পালন করতে পারে। বিশেষভাবে, তরুণ ভোটাররা যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকবেন, তখন তারা দেশে টেকসই গণতন্ত্র নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সর্বজনীন শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে পারবেন। উপরন্তু, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নতুন ভোটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি প্রাণবন্ত গণতন্ত্র বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি সমুন্নত করার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ও সমর্থন আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অজস্র তরুণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মূল প্রতিশ্রুতি ছিল বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নির্মাণ। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরে রাজনৈতিক বিভিন্ন পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদসহ নানা অশুভ প্রভাব এই দেশের তরুণ সমাজের একটি অংশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ছাড়া সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য, বেকারত্বসহ তরুণদের এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। উপরন্তু, ভোট হলো গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম টুল। তাই নিজ নিজ সমস্যার সমাধানকল্পে হলেও ভোটাধিকার প্রয়োগে বদ্ধপরিকর হতে হবে।

বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে গণতন্ত্রের বিকাশ ও কার্যকারিতা। এই ধারাবাহিকতায় জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে নতুন সংযোজন হচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। নতুন ভোটাররা ইভিএমের কার্যকর প্রয়োগ বাস্তবায়নে তাত্পর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন, কারণ তারা প্রবীণ ভোটারদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকে বেশি অগ্রগামী ও সচেতন।

পরিশেষে বলা যায়, নতুন ভোটারদের বহুবিধ দৃষ্টিভঙ্গি, দৈনন্দিন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা, রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি হ্রাস, বৃহত্তর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তৈরি এবং আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করতে সক্ষম। তারা ভোটার হিসেবে নিছক ভোট প্রদান করবেন, এমনটি নয় বরং এর মাধ্যমে তাদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এটি জাতির ভবিষ্যত্ দিকনির্দেশনা তৈরি এবং আগামী দিনগুলোর জন্য একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ভিত্তি নিশ্চিত করবে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নতুন ভোটারদের মুখ্য ভূমিকা বোঝা শুধু রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় নয়, দেশের বিকশিত গণতান্ত্রিক আখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

লেখক: ড. সাদেকা হালিম, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক তথ্য কমিশনার

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments