Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeআন্তর্জাতিকইরানের এবারের হামলায় সামনে এল ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন শঙ্কা

ইরানের এবারের হামলায় সামনে এল ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন শঙ্কা

জয় বাংলাদেশ : ইসরায়েলের তেল আবিব শহরে গত মঙ্গলবার রাতে নেমে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র। এ দৃশ্য অবশেষে আঞ্চলিক সংঘাত শুরু হওয়ার স্পষ্টতম সংকেত দিচ্ছে। এক বছর ধরে অঞ্চলটিতে এ ধরনের সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল।

এবার নিয়ে ছয় মাসের কম সময়ে মধ্যে ইসরায়েলে আকাশপথে দ্বিতীয়বার হামলা চালাল ইরান। কিন্তু গতবার হামলার কয়েক দিন আগে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তখন হামলার শুরুতে অনেক বেশি ধীরগতির ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল জনবিরল নেগেভ মরুভূমিতে অবস্থিত একটি সামরিক ঘাঁটি।

এবার হামলাই শুরু করা হয়েছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে। তা ছোড়ার পর ইসরায়েলের আকাশ সীমায় প্রবেশ করতে সময় লেগেছে ১২ মিনিট। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এবার ইসরায়েলের ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকাকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে স্থানীয় গণমাধ্যমে এবারের হামলাকে (ইসরায়েলের বিরুদ্ধে) ইরানের যুদ্ধ ঘোষণা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হামলায় হতাহতের তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এবার একাধিক শহরকে লক্ষ্যবস্তু করায় ইসরায়েলের পাল্টা হামলা জরুরি হয়ে পড়েছে। গত এপ্রিল মাসে ইরানের প্রথম দফা হামলার পর ইসরায়েলের প্রত্যুত্তর হামলা ছিল মোটাদাগে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দেওয়ার বিষয়। তখন ইরানের ভেতরে হামলায় দেশটির ইস্পাহানের নিকটবর্তী একটি সামরিক ঘাঁটির একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তল্লাশিচৌকিকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল ইসরায়েল।

মঙ্গলবার রাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের নাগরিকেরা সুস্পষ্টভাবে হুমকিতে পড়েছেন। এ অবস্থায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অনেক বেশি সর্বাত্মকভাবে ইরানকে পাল্টা জবাব দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্ভাব্য হামলা নিয়ে এরই মধ্যে ছক কাটা হয়েছে। ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা সুনির্দিষ্ট করে নেওয়া হবে। লক্ষ্যবস্তুর তালিকা বড় ও ভারী হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। এবার লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো থাকতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

মঙ্গলবার ইসরায়েলে ইরানের আসন্ন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে সবার আগে সতর্কতা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। হামলার আগে মার্কিন কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বিষয়টি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। ইরানের হামলার পূর্বাভাস দিতে পারায় যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। পূর্বাভাস করতে পারায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ইরানের হামলা ওয়াশিংটনের জন্য আচমকা ছিল না।

ইসরায়েলে ইরানের এবারের হামলা একদিকে যেমন মধ্যপ্রাচ্যের জন্য সব ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে। অন্যদিকে মার্কিন রাজনীতিতেও এর গুরুতর প্রভাব পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মাত্র পাঁচ সপ্তাহ আগেই এ ঘটনা ঘটল। রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মার্কিন প্রশাসন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্বল বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন।

এদিকে গাজায় ইসরায়েলের জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে শান্তিচুক্তি বা যুদ্ধবিরতির জন্য কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করেও সফল হয়নি মার্কিন প্রশাসন। অন্যদিকে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ফ্রান্সকে দলে টেনে লেবাননে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টাও মুখ থুবড়ে পড়েছে।

গত সপ্তাহে নেতানিয়াহু জাতিসংঘের অধিবেশনে বক্তৃতা দেওয়ার অল্প সময় পরেই গত শুক্রবার বৈরুতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হন। মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলে ইরানের সবচেয়ে বড় অংশীদার ছিলেন তিনি। এই অবস্থায় মঙ্গলবার রাতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নাসরুল্লাহর মৃত্যু এবং জুলাই মাসের শেষ দিকে তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে গুপ্তহত্যার প্রতিশোধ বলে উল্লেখ করেছে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)।

গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অঞ্চলটিতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া ঠেকিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করেছেন বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কিন্তু তাঁদের এ দাবি এখন আর তেমন একটা গুরুত্ব বহন করছে না।

গত এপ্রিল মাসে ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে পাল্টা হামলা চালানোর বিষয়ে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু এবারের হামলার পর ইসরায়েলকে সংযত থাকতে বলার মতো অবস্থা নিজেদের নেই বলে তেহরানের প্রতি ওয়াশিংটন ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।

এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহু স্বাধীনভাবে যেকোনো পদক্ষেপের অধিকার অর্জন করেছেন। সে কারণে তেল আবিবকে লক্ষ্য করে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর তাঁর পদক্ষেপ নিয়ে কিছু বলা ওয়াশিংটনের জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে নেতানিয়াহুর বিরোধীদের তাঁর পদত্যাগের আহ্বান জানানো অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে।

মঙ্গলবার নেতানিয়াহু তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত বাসনার আরও কাছাকাছি পৌঁছেছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ইরানের বিরুদ্ধে নিজেদের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্ত করতে চাচ্ছিলেন, যে যুদ্ধের মাধ্যমে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ধ্বংস করা যাবে।

তেহরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখতে প্রধান বিশ্ব শক্তিগুলোর সঙ্গে ২০১৫ সালে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) করেছিল ইরান। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিটিতে থেকে সরে আসার পর তা অকার্যকর হয়ে যায়। এরপর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয় ইরান। ধারণা করা হয়, দেশটি এরই মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।

এখন পর্যন্ত যা জানা যায়, ইরানের মঙ্গলবার রাতের হামলায় ইসরায়েলে যৎসামান্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের আকাশ সীমায় পৌঁছাতে সময় লেগেছে ১২ মিনিট। এর ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পারমাণবিক ওয়ারহেডবাহী ক্ষেপণাস্ত্র ১২ মিনিটের মধ্যে ইরান থেকে ইসরায়েলে আঘাত হানতে পারে বলে একধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে এবার ইসরায়েল আঞ্চলিক শত্রুদের ধাপে ধাপে শায়েস্তা করছে। তাদের একেকটাকে ধ্বংস করার যুদ্ধে নেমেছে দেশটি। প্রথমে হামাসকে ধরেছে, এরপর এখন ধরেছে হিজবুল্লাহকে। এই পরিস্থিতি ইরানের যুদ্ধবাজ নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির যুক্তিকে শক্তিশালী করতে বাধ্য। এখন তাঁরা বলবেন, ইরানকে নিরাপদ ও শক্তিশালী রাখার একমাত্র উপায় হলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা। উল্টো দিকে এমন যুক্তি জয়ী হতে পারে, এমন ভয়ে ইসরায়েলে আত্মরক্ষার্থে শত্রুর (ইরান) ওপর আগেভাগে হামলা চালানোর আহ্বান জোরদার হবে।

এই ধরনের একটা ভয়ংকর সময়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ও উত্তেজনা কমানোর জন্য মধ্যপ্রাচ্য ঐতিহাসিকভাবে ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেই সক্ষমতা নেই। কারণ তিনি এমন এক নেতা, যাঁকে গত কয়েক মাসে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম মিত্র উপেক্ষা করেছে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছিল। এই পরিস্থিতিতে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানের হুমকি থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে চাইবেন, তাঁর ওপর সেই ধরনের হামলার চাপ বাড়বে।

বাইডেন প্রশাসন বিদেশে সামরিক অভিযান চালানোর বিষয়ে সাধারণত সতর্ক। আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হলে কমলা হ্যারিসও একই পথ অনুসরণ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে বাড়তে থাকা সহিংসতার কারণে হোয়াইট হাউসে তাঁর বাইডেনের উত্তরাধিকার হওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে এ খেলায় সবচেয়ে বড় এলোপাতাড়ি তাস তথা ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments