Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeঅন্যান্যউষ্ণায়নের অশনি সংকেত!

উষ্ণায়নের অশনি সংকেত!

‘দাও ফিরে সে অরণ্য- লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর সভ্যতা।
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী…’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নগর সভ্যতার নিষ্প্রাণ প্রাচুর্য কবিকে আহত করেছিল, ব্যথিত করেছিল, মর্মাহত করেছিল। তিনি ফিরে পেতে চেয়েছিলেন ফেলে আসা সবুজ-শ্যামল, শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতির ছায়ার মায়া। যেখানে রয়েছে অনাবিল প্রশান্তির হাতছানি। প্রকৃতি ও প্রাণের নিবিড় বন্ধন।

ছায়ার মায়ায় থাকে মায়ের মমতা, অনাবিল শান্তি, শরীর-মন জুড়ানো মিষ্টি হাওয়া। তাই বলা হয়ে থাকে, মায়ের আঁচলের মতো বটবৃক্ষের ছায়া। কিন্তু কোথায় বটবৃক্ষ! আগে গ্রামে, বাজারে, মাঠে, রাস্তার ধারে বটবৃক্ষের দেখা মিলত। এখন দুই চার দশ গ্রামেও বটবৃক্ষের দেখা মেলা ভার। যাও দুই একটা দেখা যায় তাও পঙ্গু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশি জায়গা দখল করে বলে জমির মালিক বটে ঝুরি কেটে দিয়েছে। গ্রামে এখন গাছপালা-বাগানের সংখ্যা একবারেই কমে গেছে। শহরে তো গাছপালা নেই বললেই চলে। কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে আমাদের শহরগুলো। শহরে ছায়াও নেই, ছায়ার মায়াও নেই। শতবর্ষী গাছের দেখা মেলা দুর্লভ। আর ছায়ায় ঢাকা গ্রামগুলো এখন গাছপালা শূন্য হতে চলেছে। এক কথায় বলতে গেলে শহর ঢুকে পড়েছে গ্রামে।
মনে পড়ে পেছনে ফেলে আসা সেই দিনগুলোর কথা। যখন বাবা-চাচারা আবাদি ফসলের মাঠ থেকে কাজ করে এসে পুকুর পাড়ে কিংবা বাগানের শুরু বা শেষে বড় একটা গাছের নীচে বাঁশের চটা দিয়ে বানানো সুন্দর বেঞ্চিতে বসে আরাম করতেন। ঝিরি ঝিরি বাতাসে তাদের প্রাণ জুড়িয়ে যেত। হাতে থাকতো একটা গামছা।কপালের ঘাম মুছতে মুছতে গান ধরতো- ‘যদি বন্ধু যাবার চাও, ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাওরে…।’

মা চাচীরা আখের গুড়, লবণ আর পানি মিলিয়ে শরবত বানিয়ে নিয়ে আসতেন। কোনো কোনো মা-চাচীরা আবার পিপল (এলাকা ভেদে গাছের নাম ভিন্ন হতে পারে) গাছের পাতা পানিতে চটকে, তাতে আখের গুড়, লবণ মিশিয়ে আনতেন। পেট ভরে পানি পান করে বাঁশের চটার মাচার ওপর তারা চোত্তির-বোশেখের এইদিনে শুয়ে বিশ্রাম নিতেন। কাঁচা আমের সাথে মরিচ-লবণ দিয়ে মাখিয়ে আনতেন কোনো কোনো মা চাচী। ঝিরি ঝিরি বাতাসে কখনো যে ক্লান্ত শরীর নেতিয়ে পড়তো তা তারাও বুঝতে পারতেন না। ঘুমিয়ে পড়তেন। আহ কি শান্তি! বেশি দিন আগের কথা তো নয়। আশির দশকের কথা। গ্রামগুলো তখন ছিল ঢেউ খেলানো সবুজ শাড়িতে মোড়ানো। চোখ জুড়িয়ে যেত দেখে। মনের ভেতর ভালো লাগার উছলে ওঠা ঢেউ তৈরি হতো। এখন গ্রামগুলোকে দেখলে কঙ্কালসার নেংটা মনে হয়। অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে সময়ের ব্যবধানে কালের গর্ভে। তখন কি এতো গরম পড়তো? উত্তরে বলব, না। তাহলে আজ কেন দেশজুড়ে বয়ে যাচ্ছে আগুনের স্রোত? চল্লিশ থেকে একচল্লিশ বিয়াল্লিশ উঠে যাচ্ছে তাপমাত্রার পারদ। তবে পারদ যন্ত্রের হিসেবে তাপমাত্রা যা-ই থাকুক না কেন, বাস্তবে তা অনুভূত হচ্ছে আরো বেশি। আকাশের কোনো কোণে কোনো মেঘের দেখা নেই। নেই বৃষ্টির কোনো পূর্বাভাস। তপ্ত রোদে হাঁসফাঁস করছেন মাঠের কৃষক। খোলা জায়গায় যে শ্রমিকরা কাজ করছেন তাদের নাভিশ্বাস। ভ্যান-রিকশা চালকরা তীব্র গরমে দিশেহারা। ফুটপাতে যারা সংসার চালানোর পসরা সাজিয়েছেন তাদের অবস্থা শোচনীয়। যাদের বাইরে নিত্যদিনের কাজ করেন তাদের অবস্থা তথবৈচ। মানুষ তার কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। দেশ অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়ছে। শহরের অধিকাংশ জায়গায় কোনো গাছপালা নেই যে তার নীচে দাঁড়িয়ে মানুষ একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে। গ্রামগুলোও আজ শহরের আদল পেয়েছে। মানুষ আজ বৃষ্টি প্রার্থনা করছেন- ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে…’

বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ তাপমাত্রা বেড়ে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি হলে সেটিকে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি হলে মধ্যম মাত্রার তাপপ্রবাহ, ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি হলে তীব্র বা মারাত্মক এবং ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করে। সে হিসেবে বাংলাদেশে তাপপ্রবাহ বা দাবদাহ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে। এতে করে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি।

এ বছর চৈত্রের শুরু থেকেই খরতাপে পুড়ছে দেশ। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রখর তাপ নিয়ে আলো ছড়াচ্ছে সূর্য। কড়া রোদ আর ভ্যাপসা গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন। তীব্র দাবদাহে প্রকৃতিও নিস্তেজ। হালকা বাতাস থাকলেও সেটিও গরম ছড়াচ্ছে চারদিকে। অস্থির প্রাণিকুল বিপর্যস্ত সূর্যের তপ্ত নিশ্বাসে।

বাংলার বৈচিত্র্যময় ষড়ঋতুর দেশে গ্রীষ্ম আসে প্রচণ্ড দাবদাহ আর কালবোশেখী নিয়ে। মাঠ-ঘাট ফেটে হয় চৌচির। খাল-বিল-পুকুরের পানি চলে যায় তলানীতে। এরপর আসে বর্ষার অবিরল বারিধারা। তপ্ত প্রকৃতি ও প্রাণকে শীতল করতে বর্ষার পানি পূর্ণতা দেয়। টইটুম্বুর হয়ে ওঠে কূয়ো-খাল-জলাশয়। বর্ষা গিয়ে আসে শরৎকাল। চকচকে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা বাতাসে ভর করে পাড়ি দেয় একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। রাতে মায়াবী মাধবী চাঁদের আলোর স্রোত বয়ে চলে। তার পরই আসে হেমন্ত। দুর্বাঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু, হালকা হিমেল হাওয়া আর নবান্নের আনন্দ ঢেউ বয়ে চলে বাংলাজুড়ে। দিন মাস পেরিয়ে দুয়ারে হাজির হয় শীতকাল। হিমেল হাওয়া আর কুয়াশা চাদরে ঢাকা দেশের হাড়ে লাগে কনকনে শীতের কাঁপন। তার পরই আসে ঋতুরাজ বসন্ত। গাছে গাছে রঙবাহারি ফুল, নতুন কচিপাতা, দক্ষিণা বাতাস যেন মানুষকে উত্তলা করে তোলে।
বাংলা বছরের প্রথম মাস বৈশাখ। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ হলো গ্রীষ্মকাল। বৈশাখে প্রকৃতি তপ্ত হয়ে উঠবে এটাই ঋতুর ধরন। এটাই আবহমানকাল ধরেই চলে আসছে। কিন্তু দিন যতই গড়াচ্ছে ততই তাপমাত্রার পারদ উপরে উঠছে। গত কয়েকদিন ধরে দেশের মানুষ রীতিমতো মরুভূমির লু-হাওয়ার অনুভূতি পাচ্ছেন। দেশজুড়েই চলছে অগ্নিস্রোত। তীব্র এই গরমে মানুষের সহায় হয়ে উঠেছে বিদ্যুতের পাখা। তাও কোনো কোনো অঞ্চলে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে তো কোনো কোনো অঞ্চলে বিদ্যুৎ যাচ্ছে আর আসছে। লুুকোচুরি খেলছে। তাদের ভরসা সেই পুরনো তালপাতার পাখা। মুষ্টিমেয় মানুষের ঘরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে। আর সে যন্ত্র চালু থাকায় গরমের তীব্রতা আরো তীব্র হয়ে উঠছে। কোনো অঞ্চলে যদি বৃষ্টির দেখা মিলছে তো তাদের ভেতর আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। এরপর গত দুই সপ্তাহে তাপপ্রবাহ প্রায় দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে দেখা গেছে। ইতোমধ্যেই যশোরে চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া রোববার চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আর ঢাকায় এ বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমানে পাবনা ও চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে অতিতীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর রাজশাহী, টাঙ্গাইল, যশোর এবং কুষ্টিয়ায় তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে বলে জানানো হয়েছে। এর বাইরে, ঢাকা, রাজশাহী, মৌলভীবাজার, চাঁদপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা এবং বরিশালসহ আরো কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপবাহ বয়ে যাচ্ছে।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই এপ্রিল মাসে গড়ে সাধারণত দুই-তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং এক থেকে দু’টি তীব্র থেকে অতিতীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। কিন্তু এবছর তীব্র তাপপ্রবাহ অনুভূত হওয়ায় ইতোমধ্যেই তিনটি হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও নতুন হিট এলার্ট জারি করতে হতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদরা।

‘বস্তুত সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা দুই থেকে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে’, বিবিসি বাংলাকে বলেছেন আবহাওয়াবিদ শাহ আলম। তিনি জানান, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে গড়ে তাপমাত্রা থাকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এবছর সেটি বৃদ্ধি পেয়ে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে সারা দেশেই তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। এছাড়া এ বছরের তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। সামনে গড় তাপমাত্রা আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে এটি বাংলাদেশের উষ্ণতম বছরও হতে পারে বলে জানান আবহাওয়াবিদ শাহ আলম।

তীব্র গরমে যে শুধু আমাদের দেশ পুড়ছে তা কিন্তু নয়। বিশ্বের অনেক দেশই নাকাল এই আগুন ¯্রােতে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মালদ্বীপের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের নেতৃত্বে পানির নিচে ডুবো মন্ত্রিসভার বেঠক করেন। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, এ ছাড়াও এই তালিকার প্রথম দিকে আছে পুয়ের্তোরিকা, মিয়ানমার, হাইতি, ফিলিপাইন, মোজাম্বিক, বাহামা, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও নেপাল।

নাসার গোডারড ইন্সটিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজ (জিআইএসএস) [NASA Goddard Institute for Space Studies] হিসাব দিয়েছে, ১৮৮০ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি দশকে প্রায় ০.১৫ থেকে ০.২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হারে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, বিশ শতকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিল ১৪.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কিন্তু সেটি ২০৩০ সালের আগেই ২০২৪ সালে ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

নাসার বিজ্ঞানীরা আরো বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তারই প্রভাবে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশে চলছে তীব্র দাবদাহ। আমরা ইউরোপে, চীনে এবং যুক্তরাষ্ট্রে যে তাপপ্রবাহ দেখছি তা আসলে সব রেকর্ড ভেঙে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ তাপপ্রবাহের মধ্যে আছেন। এছাড়া উত্তর আমেরিকা, কানাডা ও এশিয়ায় আবহাওয়ার অবস্থা ভয়ংকর। কানাডা ও গ্রিসে ভয়াবহ দাবানল জ্বলছে। দাবানল এবার অন্য দেশেও ছড়াচ্ছে।

কেন আজকের এই তীব্র দাবদাহ? প্রকৃতি প্রকৃতির মতো পরিবর্তিত হচ্ছে প্রকৃতির নিয়মে। এর সাথে যোগ হয়েছে মানুষের প্রকৃতি বিরোধী কর্মকাণ্ড। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে খাদ্যের জোগান, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থায় কল-কারখানা স্থাপন, বসবাসের জায়গা ইত্যাদির সমাধানকল্পে বৃক্ষনিধন, নদী ও জলাশয় ভরাট, পাহাড় কাটাসহ বিভিন্নভাবে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে। যার কারণে আজকের এই উষ্ণায়ন।

প্রায় একশো’ বছর আগে বিজ্ঞানী স্যাভান্তে আরহেনিয়াস (১৮৫৯-১৯২৭) মানুষকে সর্তক করে বলেছিলেন, ‘বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে চলেছে দ্রুত। গ্যাসটি বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়ে ভবিষ্যত পৃথিবীর বড় বিপদ ডেকে আনছে। অতএব সাবধান।’

আরহেনিয়াস ছিলেন একজন সুইডিশ পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি ১৯০৩ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯০৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন তিনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আরহেনিয়াসই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন যে বাতাসে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সরাসরি সম্পর্ক আছে। বাতাসে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন আছে ৯৯ ভাগ, বাকি এক ভাগের মধ্যে আছে অল্প পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড। ভূপৃষ্ঠ থেকে যে তাপ নিঃসরণ হয় তা শুষে নেয় কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প, পৃথিবীর তাপমাত্রা তাই বেড়ে যায়, জলবায়ুতে আসে বড় পরিবর্তন।

আরহেনিয়াসের সতর্কবার্তা পৃথিবীর মানুষ শোনেনি। ফলে প্রতিবছর, প্রতিমাস, প্রতিদিনই, প্রতিক্ষণই উষ্ণায়ন বেড়ে চলেছে। পৃথিবীজুড়ে ভয়ংকর ঝড়-বাদল-তুফান-খরা-বন্যা চলেছে। অনেক দেশ জলে ডুবে গেছে, ডুবতে বসেছে বহু দ্বীপরাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চল। এভাবে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। তারা দেশের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে। পাড়ি জমাচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ বাংলাদেশকে পোস্টার চাইল্ড (Poster Child) হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হবে এবং প্রায় তিন কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।

বৈশ্বিক জলবায়ু সূচক-২০২১ -এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ রয়েছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার।
আজকের বৈশ্বিক উষ্ণতা বা এষড়নধষ ডধৎসরহম বৃদ্ধি একটি ভয়াবহ সমস্যা যা আমাদের গ্রহের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বিভিন্ন মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধিকেই গেøাবাল ওয়ার্মিং নামে অবিহিত করা হচ্ছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং আবহাওয়া ক্রমশ বৈরিভাবাপন্ন হয়ে উঠছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক ০.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার বৃদ্ধি মানুষ, জীবজগৎ তথা প্রকৃতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে। আগে এত কম তাপমাত্রা পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। বলা হচ্ছে, বৈশ্বিকভাবে অর্ধডিগ্রি কিংবা এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে তা প্রকৃতিতে ক্লাস্টার বোমার মতো পরিণাম ডেকে আনে। উষ্ণায়নের প্রভাবে বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে দিনে দিনে শুষ্ক মরুভূমি হয়ে যাবে পৃথিবী। কীটপতঙ্গের বংশবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। জলের গুণগতমান কমে গিয়ে প্রাণিকুলের প্রজনন ক্ষমতা কমে যাবে। সবশেষে ধ্বংস হয়ে যাবে প্রাণ প্রকৃতির পৃথিবী। আর এ কারণেই ২০১৫ সালে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ-২১) ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে ২০৫০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার করা হয়।

পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয় আমাজন জঙ্গলকে। আমাজন থেকে আমরা পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০ ভাগ পেয়ে থাকি। এই পৃথিবীর ফুসফুসেও আজ ক্ষতর সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ নিজস্ব স্বার্থে ইচ্ছেমতো ধ্বংস করছে আমাজনকে। অথচ এই উষ্ণয়ন থেকে রক্ষা পাবার উপায় হলো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে, অপ্রচলিত শক্তি ও জৈব সারের ব্যবহার বাড়িয়ে, পেট্রোলিয়ামের অপচয় রোধ করে এবং সর্বোপরি নির্বিচারে বৃক্ষনিধন বন্ধ করে বনসৃজন করতে হবে। যদিও অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বলেছেন, ‘বৃক্ষায়ন আসলে পরিবেশের রোগ নিরাময়ে ‘টোটকা’ চিকিৎসা মাত্র। বন ধ্বংস অবশ্যই উষ্ণায়নে ইন্ধন যুগিয়েছে কিন্তু এটাই মূল কারণ নয়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি রোপিত বন মোটেও প্রাকৃতিক বনের সমতুল্য নয়। পরিবেশ সংকটের মূলে আছে শিল্প বিপ্লব। বিগত চারশো’ বছরে কল-কারখানা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য মাধ্যম থেকে পৃথিবীতে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস ও কঠিন বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হয়েছে সেগুলোই বিদ্যমান বিপর্যয়ের হেতু। এসব দূষণ বন্ধ না হলে বৃক্ষরোপণ বা বনায়ন এককভাবে কোনো ফল ফলাবে না।’

‘গাছ লাগিয়ে পৃথিবীর উষ্ণতা কমানো এবং চিনি ঢেলে সমুদ্রের জলকে মিষ্টকরণের একই অপচেষ্টার সামিল’ আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে এই মন্তব্য করেছিলেন লন্ডনে কর্মরত বাংলাদেশি পরিবেশবিদ ড. কানন পুরকায়স্ত।

প্রকৃতি প্রকৃতির নিয়মেই পরিবর্তিত হচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে মানুষের প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মকাÐ। ফলাফল আজকের এই উষ্ণায়ন। জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে অধিক বৃক্ষরোপণই এর সমাধান হতে পারে। আমার বিশ্বাস, সুন্দর এ গ্রহ টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে বিজ্ঞানের বদৌলতে অদূর ভবিষ্যতে জিরো কার্বন নিঃসরণে নেমে আসবে পৃথিবী। কার্বন শোষনের যান্ত্রিক প্রক্রিয়া মানুষই আবিস্কার করবে। চলমান থাকবে সভ্যতার ক্রমবিকাশ।

লেখক: তুষার কান্তি সরকার, সম্পাদক, নিসর্গবার্তা

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments