Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeস্বদেশ সংবাদএনআরবি ব্যাংক খাদক মাহতাবুর এখনো আছেন বহাল তবিয়তে

এনআরবি ব্যাংক খাদক মাহতাবুর এখনো আছেন বহাল তবিয়তে

# ২০১৬ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান ব্যাংকটিতে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
# ব্যাংক কোম্পানী আইন অমান্য করে পরিবারের ২৪ শতাংশ শেয়ার ধারণ ও ৫জন পরিচালক নিয়োগ
# প্রথম তিন বছর খেলাপি ঋণ না থাকলেও বর্তমানে তা ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ
# অর্থপাচারসহ ঋণ কেলেঙ্কারির নানাবিধ অভিযোগ

জয় বাংলাদেশ : রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর একটি এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড। চেয়ারম্যানের একক নিয়ন্ত্রণ ও স্বেচ্ছাচারিতায় বর্তমানে নাজুক পরিস্থিতে পড়েছে ব্যাংকটি। পর্ষদের অনৈতিক হস্তক্ষেপে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণও এখন চেয়ারম্যানের দখলে রয়েছে। এর ফলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায়ও নানারকম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে। নামে-বেনামে ঋণ বিতরণ করায় তা আদায় হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

বৈধ পথে প্রবাসীদের আয় দেশে আনার শর্তে শতভাগ প্রবাসীদের মালিকানায় এই ব্যাংকটির অনুমোদন দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করা ব্যাংকটির প্রথম প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন ইকবাল আহমেদ। তিন বছর পর ঘটনাক্রমে ২০১৬ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন বিশিষ্ট প্রবাসী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান। এই পরিবর্তনের পর ইকবাল আহমেদসহ অনেক মূল প্রতিষ্ঠাতাকে ব্যাংকের পর্ষদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। সেইসাথে অবৈধভাবে নামে-বেনামে ব্যাংকটির শেয়ার কিনেন মাহতাবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে ব্যাংকটিতে তার পরিবারের ৫ জন সদস্য সরাসরি পরিচালক হিসেবে আছেন। আর এই ৫ জনের ধারণকৃত শেয়ারের পরিমাণ প্রায় ২৫ শতাংশ। যদিও ব্যাংক কোম্পানী আইন অনুযায়ী, কোনো পরিবার একটি ব্যাংকের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারবে। অর্থাৎ ব্যাংক কোম্পানি আইন স্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন মাহতাবুর রহমান। এর ফলে ব্যাংকটিতে পারিবারিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ব্যাংকটি থেকে অর্থ সরিয়ে তা পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। এতে ব্যাংকটির স্বাস্থ্যও দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে। প্রতিষ্ঠার প্রথম তিন বছর ব্যাংকটিতে কোন খেলাপি ঋণ না থাকলেও ২০১৬ সাল থেকে আগ্রাসী ব্যাংকিং করায় খেলাপি ঋণের খাতায় নাম লিখিয়েছে ব্যাংকটি। ওইসময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট বিতরণকৃত ঋণের ১ দশমিক ৯ শতাংশ। যা বর্তমানে কয়েক গুণ বেড়ে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ হয়েছে। শুধু তাই নয়, অতি সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে যে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে, সেখানে ব্যাংকখেকো নজরুল ইসলাম মজুমদারের সাথে তিনিও হত্যা মামলার আসামি চিহ্নিত হয়েছেন। গত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়িতে ইমন হোসেন গাজী হত্যার অভিযোগে তার ভাই আনোয়ার হোসেনের করা মামলায় গত ১১ সেপ্টেম্বর মাহতাবুর রহমান এবং নজরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তবর্তীকালীন সরকারের আগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি ব্যাংকখাতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি ১১ টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট এবং অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এসব ব্যাংকের পর্ষদ ভাঙ্গা হয়েছে। এনআরবি ব্যাংকেও একই ধরনের সমস্যা থাকলেও এখনও এই ব্যাংকটির বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয় নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালে ব্যাংকের সাতজন উদ্যোক্তা তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। সেই অভিযোগে চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমান নীতি লঙ্ঘন করে ব্যাংকের উপর পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো, ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ক্ষমতা ক্ষুন্ন করা, গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা, ঋণ খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও চেয়ারম্যান পদে আঁকড়ে থাকা এবং তার ব্যক্তিগত ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ব্যাংক ব্যবহার করার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল। অভিযোগ পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্তও শুরু করে। কিন্তু সরকারের উপর মহলের মাধ্যমে ওই তদন্ত বন্ধ করেন তারা। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমান ব্যাংক কোম্পানী আইনের তোয়াক্কা না করে তার পরিবারের লোকজনকে দিয়ে বেনামে শেয়ার ক্রয় করিয়েছেন। আর এসব দুর্নীতি ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তেই ধরা পড়েছে। এর আগেও পুঁজিবাজারে শেয়ার কারসাজিকারীদের সুবিধা দিতে গিয়ে বড় অঙ্কের লোকসান করেছিলো এনআরবি ব্যাংক।

একই সময়ে দুদকেও একটি অভিযোগ দিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাহমুদ ইকবাল। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান।

মানিলন্ডারিং ও অবৈধ হুন্ডির আন্তর্জাতিক ডন হিসেবেই তার পরিচিতি সারাবিশ্বে। বাংলাদেশ থেকে রাঘব বোয়ালদের হাজার হাজার কোটি টাকা অর্থপাচারের প্রধান মাধ্যম হলো মাহতাবুর রহমান। হুন্ডির মাধ্যমে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের উপার্জিত অর্থ নিজের কোম্পানির মাধ্যমে দেশে আনছেন তিনি। মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে আবার সে অর্থ বৈধ পথে দেশে আনছে মাহতাবুর রহমান। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী পদক জেতা ও সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া সিআইপি পদবি পাওয়ার উদ্দেশ্যেই এ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ তৎপরতায় সফল হয়ে গত কয়েক বছর ধরে মাহতাবুর রহমান এ দুটি পদক ও পদবি পেয়ে আসছেন। আর নিজের অপকর্মকে বৈধ করার জন্য পদক ও পদবিকে অপব্যবহার করছেন। মাফিয়া ডন হিসেবে মাহতাবুর রহমানের নাম আছে এফবিআই, ইন্টারপোলসহ আন্তজাতিক বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কালো তালিকায়। সম্প্রতি দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, সিআইডি, বিএফআইইউসহ একাবিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান মাহতাবুর রহমানের অবৈধ সম্পদ, সোনা চোরাচালান, মানি লন্ডারিংসহ বিভিন্ন অপকর্মের তদন্ত শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে গত বছর তার ও তার পরিবারের সদস্যদের সকল ব্যাংক হিসাব তলব করেছিল বিএফআইইউ। তাদের তদন্তে দেখা যায়, গত এক দশকে মাহতাবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা শুধু ব্যাংকিং চ্যানেলেই ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন করেছেন।

যেভাবে ব্যাংকটির শুরু

এনআরবি ব্যাংক প্রাথমিকভাবে যুক্তরাজ্যের প্রবাসী ব্যবসায়ী ইকবাল আহমেদ (ওবিই) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি, সিঙ্গাপুর, জাপান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে বসবাসকারী ৪৬ জন প্রবাসীর কাছ থেকে সমর্থন অর্জন করেছিলেন। ১৭ এপ্রিল, ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ইকবাল আহমেদের নামে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি লেটার অব ইনটেন্ট জারি করে, যার ফলে এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড গঠন করা হয়। ইকবাল আহমেদ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও ২০১৬ সালে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন বিশিষ্ট প্রবাসী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান (নাসির)। এই পরিবর্তনের পর ইকবাল আহমেদসহ অনেক মূল প্রতিষ্ঠাতাকে ব্যাংকের পর্ষদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। ৪৬ জন প্রবাসীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে ব্যাংকটি এখন একটি একক পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, অধিকাংশ মূল উদ্যোক্তা আর পর্ষদে নেই। বর্তমানে মাহতাবুর রহমানের স্ত্রীসহ তার পরিবারের ৫ জন সদস্য ব্যাংকের পর্ষদে দায়িত্ব পালন করছেন। এনআরবি ব্যাংক প্রবাসী ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে গঠিত হলেও এখন পরিচালকদের অনেকে দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আবার ব্যাংকটির মূল উদ্যোক্তাদের অনেকে ব্যাংক থেকে দূরে সরে গেছেন। ফলে একটি পক্ষের হাতে পুরো ব্যাংকটি জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিঙ্গাপুর প্রবাসী উদ্যোক্তা পরিচালক মোহাম্মদ বদিউজ্জামান কালবেলাকে বলেন, এনআরবি ব্যাংকের শুরু থেকেই আমি ছিলাম। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব পালন করি। ওই সময় যারা পরিচালক ছিল তাদের কৌশলে সরিয়ে দেন মাহতাবুর রহমান। তিনি বলেন, এক একটি শেয়ার চড়া দাম দিয়ে নিজে কিনে নেন, পরিবার, আত্মীয়দের নামে কেনে। যে দামে শেয়ারগুলো কিনেছিল তার থেকেও কাগজে-কলমে তার থেকে কম দাম দেখানো হয়। একে একে ২৪ শতাংশ শেয়ার কেনে তার পরিবারের ৬ জন, তার স্ত্রী, ভাই, ভাইপো, তার স্ত্রী। ৩ বছর পরপর শুরুতে যারা পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার ছিলেন তাদের বিভিন্নভাবে বাদ দিতে থাকে ৷ এভাবে ব্যাংকের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। আমার দায়িত্বকালিন শেষ এক বছর কোনো মিটিং করতে দেয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর একজন উদ্যোক্তা পরিচালক বলেন, গোলাম কবির স্থানীয় সবকিছু দেখাশোনা করত। পর্ষদের সদস্যরা সভায় হাজির হলে ৫ হাজার ডলার দেয়া হতো। কিন্তু সেখানে বিদেশ থেকে দেশে আসার প্লেন ভাড়া, হোটেল খরচ এসব ভাউচার দেখানোর নিয়ম ছিল। কিন্তু দেখা গেছে অনেকে দেশে থেকে জুমে মিটিং করে বছরে ৪ মিটিংয়ে ২০ হাজার ডলার আয় করেছে। কিন্ত এসব নিয়ে বলার কেউ ছিল না। কারণ অধিকাংশ ছিল তার পক্ষের লোক।
একই বিষয়ে নন স্পন্সর শেয়ার হোল্ডার নসরত খলিল চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, আমার বাবা ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। পরে আমাকে সেখানে পরিচালক করার কথা হয়। ২০১৬-১৭ সালে মাহতাবুর রহমান চেয়ারম্যান হওয়ার পর এটা নিয়ে ২/৩ টা ওই সময়ের পরিচালনা বোর্ডের সাথে মিটিং করেছিলাম। কিন্তু এক এক করে পুরাতন অনেকে ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হয়। নিয়ম অনুযায়ী কেউ শেয়ার বিক্রি করলে পর্ষদের সবাইকে অফার করতে হয়। কিন্তু সেটা না করে নিজেদের মধ্যে শেয়ার কেনে। এভাবে তার শেয়ার বাড়তে থাকে। সেসময় প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগও করেছিল। নতুন চেয়ারম্যান তার নিজের লোক, পরিবারের নামে শেয়ার কেনা শুরু করে। বিভিন্ন এজিএমে আমি ব্যাংকের অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। একসময় বোর্ডের অধিকাংশ পরিচালক মাহতাবুর রহমানে পক্ষের লোক হয়ে যায়। তারা সবাই মিটিং বা এজিএমে আসেন চেয়ারম্যানের যে কোনো সিদ্বান্ত পাস করানোর জন্য।

ব্যাংক কোম্পানী আইন লঙ্ঘন

মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান ২০১৬ সাল থেকে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এসময় থেকেই তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে শেয়ার কিনে দেন। এই বছরের আগস্ট শেষে ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ শেয়ার মাহতাবুর রহমান এবং তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের নামে চলে আসে। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, মাহতাবুর রহমান ও তার পরিবার ব্যাংকটির মোট ২৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন। এর মধ্যে মাহতাবুরের স্ত্রী, তার দুই ভাগ্নে, এক ভাগ্নের স্ত্রী, দুই মেয়ে, ভাই, পুত্রবধূ।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার কেন্দ্রীভূত করা যাবে না। এছাড়া কোন ব্যক্তি, কোম্পানি বা কোন পরিবারের সদস্যরা একক, যৌথ বা উভয়ভাবে কোন ব্যাংকের শতকরা দশভাগের বেশি শেয়ার ক্রয় করতে পারবে না। কিন্তু এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমান নিজ ও স্ত্রীর নামে, ছেলে, ছেলের বউ, চাচা, দুই ভাতিজা ও তাদের স্ত্রীদের নামে শেয়ার কিনেছেন। যদিও ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো পরিবার একটি ব্যাংকের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারবে। অর্থাৎ ব্যাংক কোম্পানি আইন স্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন মাহতাবুর রহমান। সেইসাথে ব্যাংকটির পর্ষদে রয়েছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমান, তার স্ত্রী বায়জুন এন চৌধুরী, ভাগ্নে মোহাম্মদ এহসানুর রহমান ও মোহাম্মদ আশফাকুর রহমান এবং ভাগ্নের স্ত্রী ডা. রাফা জায়গীরদার ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানী আইন অনুযায়ী, এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিন জন পরিচালক পদে থাকতে পারবেন। এক্ষেত্রেও ব্যাংক কোম্পানী আইনের লঙ্ঘনের প্রমাণ এই ব্যাংকটি।

দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালে প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত যে তিনটি ব্যাংককে দেশে ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে অনুমোদন দেয়, তার মধ্যে একটি এনআরবি ব্যাংক। তিন ব্যাংকের মধ্যে এনআরবি ব্যাংকটিই প্রকৃত প্রবাসী ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে গঠিত হয়। অন্য দুটির সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও যুক্ত ছিলেন। প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত তিন ব্যাংকের মধ্যে একমাত্র এনআরবি ব্যাংকের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। পাশাপাশি এই ব্যাংকে যে মূলধন, তা বিদেশ থেকে আসে। ফলে শুরু থেকে ব্যাংকটি নিয়ে উচ্চাশা ছিল। তবে দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে ব্যাংকটি সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ ওবিই ব্যাংকটি ছাড়ার পর এখন সেটি একটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। পরিচালকদের কেউ কেউ ব্যাংকে নিয়মিত অফিস করে দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করছেন। এর মধ্যে ব্যাংকটির এমডি মাহমুদ মেনন শাহ মেয়াদ শেষের আগেই পদত্যাগ করেন। জানা গেছে, পর্ষদের অনৈতিক চাপ মানতে না পারায় ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগ করেছেন।

ঋণ অনিয়মের অভিযোগ

এনআরবি ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকজন পরিচালকের চাপে ব্যাংকটিতে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ঋণ অনুমোদন হয়, যা নিয়মিতভাবে আদায় হচ্ছে না। সম্প্রতি আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়, যার বেশির ভাগই বেনামি ঋণ। এই বেনামি ঋণের জের ধরেই এমডি পদ ছেড়ে দেন। এনআরবি ব্যাংকের নথিপত্র অনুযায়ী, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর অ্যালায়েন্স হাসপাতালের নামে ৫৫ কোটি টাকা চলতি মূলধন ঋণের অনুমোদন হয়। হাসপাতালটি ভাড়া ভবন থেকে পরিচালিত হয়, ঋণের বিপরীতে তেমন কোনো জামানতও নেই। ঋণটির আদায় ইতিমধ্যে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। একইভাবে গত বছরের আগস্টে নতুন নিবন্ধিত হওয়া বরুণ করপোরেশনের ১৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়। এই ঋণও নিয়মিতভাবে ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকটি। গত আগস্টে বেলা অ্যাগ্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় চার কোটি টাকা। এই ঋণ ইতিমধ্যে অনাদায়ী হয়ে পড়েছে। এমন আরও কয়েকটি ঋণ প্রস্তাব সম্প্রতি ব্যাংকটিতে আসে, যা অনুমোদনের জন্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়া হয়। এর জের ধরে এমডি পদত্যাগ করেন বলে ব্যাংকটির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এনআরবি ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন মামুন মাহমুদ শাহ। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে গত ২১ জানুয়ারি ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া পদত্যাগপত্রে এমডি উল্লেখ করেন, ব্যক্তিগত কারণে তিনি এনআরবি ব্যাংকে মেয়াদ থাকা পর্যন্ত চাকরি করতে পারছেন না।
ব্যাংকটির অন্য একটি সূত্র জানায়, ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদকে ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে কৌশলে সরিয়ে দেওয়ার পর নামে–বেনামে ঋণ তৈরি হওয়া শুরু হয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ব্যাংকটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন পরিচালক।

আর্থিক স্বাস্থ্যের অবনতি

মাহতাবুর রহমানের একক কর্তৃত্বে ব্যাংকটি পরিচালিত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থেরও অবনতি হয়। প্রথম তিন বছর ব্যাংকটিতে কোন খেলাপি ঋণ না থাকলেও ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো মোট বিতরণকৃত ঋণের ১ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরপর থেকে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। এরপর সেটা কিছুটা কমে ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ, ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ৩ দশমিক ২২ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩ সালের শেষে তা আবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সবশেষ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, যেখানে ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর পরিশোধিত মূলধন ৫৯০ কোটি টাকা। কর পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৭৯ কোটি টাকা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা শিখা বলেন, আর্থিক অনিয়ম, ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়েছেন। আপাতত আর কোন ব্যাংকের পর্ষদ ভাঙ্গার কোন পরিকল্পনা নেই। তবে এনআরবি ব্যাংকের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেলে নিশ্চয়ই সেটি তদন্ত সাপেক্ষে বিবেচনা করা হবে।

সার্বিক বিষয়ে এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমানের সাথে যোগাযোগের জন্য ব্যাংকে গিয়ে জানা যায় , তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। পরে হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে হলেও তিনি তা ধরেন নি। ক্ষুদে বার্তার উত্তরও দেন নি।

 

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments