‘হে গাজা, ভয় নেই, তোমার কণ্ঠে শ্রবণযোগ্য প্রতিধ্বনি,
আমরা দেখছি ও শুনছি, তবে কথা বলা বারণ।
গাজার মাটিতে বিষাদ ও ক্ষত বাড়ছে,
চারদিকে আগুন জ্বলছে,
তবে আরবরা স্বাধীন, তারা ঘরের রক্ষক
সংকল্প আর সংকল্প করে তারা বিষয়টির নিন্দা করছে
আমরা দেখছি ও শুনছি, কিন্তু কথা বলা বারণ।’
-ফয়সাল মুহাম্মদ আল-বালায়ী
গাজা উপত্যকাকে বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র বলা হয়। গাজার প্রতিটি গ্রামে বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির আছে। যেখানে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের পর বাস্তুচ্যুত হওয়া ফিলিস্তিনিদের রাখা হয়েছে। উপত্যকার নামকরণ হয়েছে এর ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী গাজা শহরের নামানুসারে। কেনানীয়রা সম্ভবত গাজার নাম দিয়েছিল, যার অর্থ প্রাচীন সেমেটিক ভাষায় ‘শক্তি’। মিশরীয়রা একে ‘গাজ্জাত’ (পুরস্কারের শহর) বলে ডাকত। গাজা শহরকে বিশ্বের সপ্তম প্রাচীন শহর হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে গাজা এখন ধ্বংসের নগরী, কান্নার শহর। ইসরায়েলিদের বোমায় এখানে বিপণ্ন মানবতা। কেবল ধ্বংস, বেদনা আর নিষেধাজ্ঞা, দারিদ্র্য ও বিচ্ছিন্নতার স্মৃতি নিয়ে এখানকার অধিবাসীরা বেঁচে আছে।
শিল্পী সালভাদর দালি (১৯০৪-১৯৮৯)-এর পরাবাস্তবাদ আর লাতিন ঔপন্যাসিক গার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯২৭-২০১৪)-এর যাদুবাস্তবতার ভূরি ভূরি মেছাল পাওয়া যাবে গাজা উপত্যকায়। ইসরায়েলি জল্লাদদের কসাইখানায় রূপ নিয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা। এই উপত্যকা পশ্চিম এশিয়ার পঁচিশ মাইল দীর্ঘ ভূমির অংশ। এটির দক্ষিণে মিশর ও পূর্বে ইস্রায়েলের সীমানা। আর এর পশ্চিম উপকূলে ভূমধ্যসাগর অবস্থিত।
এখানে যা ঘটছে তা হচ্ছে- একটা মানুষ, একটা জাতি, সংস্কৃতি, পরিচয় মুছে ফেলার নিরন্তর দানবীয় প্রচেষ্টা।
মাত্র দশ বছর। এর মধ্যে ইসরাইল মোসাদকে দিয়ে ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী গাস্সান কানাফানি, মাজেদ আবু শারর ও কামাল নাসের এই তিনজনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। ১৯৭২ সালে কানাফানি, ১৯৭৩ সালে নাসের ও ১৯৮১ সালে আবু শরার। সেই যে কবি সাহিত্যিক হত্যা মিশন শুরু হয়েছিল তা আজ গাজা অব্দি পৌঁছেছে। আমাদের মর্মাহত করছে প্রতিনিয়ত সেখানকার কবি সাহিত্যিকদের হত্যাকাণ্ড। অবাক বিশ্ব, অবাক তাকিয়ে রয়।
গাজায় হামলার শুরুতে যাঁদের নাম এসেছে গণমাধ্যমে এ রকম কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির কথা এখন আমরা লিটারারি হাবের বদৌলতে তুলে ধরছি- এই তালিকার প্রথমজন হচ্ছেন- হেবা আবু নাদা। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। ফিলিস্তিনি সাহিত্যিক স¤প্রদায়ের কাছে একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসের নাম ‘অক্সিজেন ইজ নট ফর দ্য ডেড’। তিনি ২০ অক্টোবর দক্ষিণ গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন।
৮ অক্টোবর ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন- ‘গাজার রাত রকেটের আভা ছাড়া অন্ধকার, বোমার আওয়াজ ছাড়া শান্ত, প্রার্থনার আরাম ছাড়া ভয়ঙ্কর, শহীদদের আলো ছাড়া কালো। শুভ রাত্রি, গাজা।’
আবু নাদা গাজার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি গাজার আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লিনিকাল নিউট্রিশনে স্নাতকোত্তর। ২০১৭ সালে আবু নাদা ‘অক্সিজেন ইজ নট ফর দ্য ডেড’র জন্য শারজাহ পুরস্কার লাভ করেন।
তালিকার দ্বিতীয়জন হলেন- ওমর আবু শাওইস। তিনি কবি ও ঔপন্যাসিক। ৭ অক্টোবর ওমর ফারিস আবু শাওইস গাজার নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে গোলাগুলির সময় নিহত হন।
আবু শাওইস বেশ কয়েকটি যুবসংঘের সহপ্রতিষ্ঠা ছিলেন। ২০১৩ সালে আরব লীগের সমন্বিত উন্নয়নের জন্য আরব যুব কাউন্সিল কর্তৃক ‘মিডিয়া, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশিষ্ট আরব যুবক’ পুরস্কারও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস, ‘আলা কায়েদ আল-মাওত (২০১৬)’।
গাজার এই তালিকার তৃতীয়জন হলেন- ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর কবি, লেখক ও সাহিত্যের অধ্যাপক ড. রেফাত আলিরের ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। একই সাথে তাঁর ভাই, তাঁর বোন ও তাঁর চার সন্তানও নিহত হয়।
তিনি ‘গাজা আনসাইলেন্সড (২০১৫)’-এর সহ-সম্পাদক ও ‘গাজা রাইটস ব্যাক: শর্ট স্টোরিজ ফ্রম ইয়াং রাইটার্স ইন গাজা, প্যালেস্টাইন (২০১৪)’-এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘গাজাকে রক্ষায় আমাদের কাছে লড়াই করা ও তার গল্প বলার বিকল্প নেই।’
অন্যদিকে লেখক ও ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যের আইনজীবী আব্দুল করিম আল-হাশাশ পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ ২৩ অক্টোবর রাফাহ শহরে নিহত হন। আল-হাশাশ ফিলিস্তিনি লোক ঐতিহ্য ও বেদুইন ঐতিহ্য, রীতিনীতি আর আরব প্রবাদ সম্পর্কে তাঁর গবেষণার জন্য পরিচিত ছিলেন।
এই হত্যার মিছিলের আরেকটি নাম ইনাস আল-সাকা। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত নাট্যকার, অভিনেত্রী ও শিক্ষাবিদ যিনি শিশুদের থিয়েটারে ব্যাপকভাবে কাজ করেছেন। অক্টোবরের শেষের দিকে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তাঁর তিন সন্তানÑ সারা, লিন ও ইব্রাহিমসহ তিনি নিহত হন। সাকা ও তাঁর পাঁচ সন্তান গাজা শহরের একটি দালানে আশ্রয় নিচ্ছিলেন। সে সময় একটি ইসরায়েলি বিমান হামলার শিকার হন তিনি।
ফিলিস্তিনি কবি খালেদ জুমা বন্ধু সাকার মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে লিখেছেন, ‘আজ আমার বন্ধুর পর্দা পড়ে গেছে… আর থিয়েটারের মঞ্চ অন্ধকার হয়ে গেছে।’
সাকার শেষ ফেসবুক পোস্ট ছিল ২৭ আগস্ট তারিখে। এতে তিনি গাজার অতীতের ভয়াবহতা থেকে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। তিনি কি জানতেন অক্টোবরে মৃত্যু তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি অতীতকে স্মরণ করে লিখেন- ‘কখনো কখনো আপনি পিছনে ফিরে তাকান আর একঝলক দেখুন আপনার অতীত। আর এটা দেখবেন নিজেকে আবিস্কার করার জন্য। আপনি কীভাবে একটি গণহত্যা থেকে জীবিত বেরিয়ে এসেছেন!’
এ রকম খুনের আরো একসার নাম জিহাদ আল-মাসরি (গবেষক ও ঐতিহাসিক), ইউসুফ দাওয়াস (লেখক, সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও গিটারিস্ট), শাহাদাহ আল-বুহবাহন (কবি ও গবেষক), নুর আল-দ্বীন হাজ্জাজ (কবি ও লেখক)।
২ ডিসেম্বর আল-শুজাইয়ায় তাঁর বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। তিনি ‘দ্য গ্রে ওনস (২০২২)’ নাটক ও ‘উইংস দ্যাট ডো নট ফ্লাই (২০২১)’ উপন্যাসের লেখক ছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহির্বিশ্বের কাছে তাঁর শেষ বার্তা ছিল, ‘এ জন্যই এখন লিখছি; এটা আমার শেষ বার্তা হতে পারে যা মুক্ত বিশ্বের কাছে পৌঁছাবে। শান্তির ঘুঘু হয়ে উড়ে যাবে এটা জানাতে যে আমরা জীবনকে ভালোবাসি।…গাজায় আমাদের সামনে সমস্ত পথ অবরুদ্ধ, আর এর পরিবর্তে আমরা মৃত্যু থেকে দূরে… শুধু একটি টুইট বা ব্রেকিং নিউজ স্টোরি।
যাই হোক, আমি শুরু করছি।আমার নাম নুর আল-দীন হাজ্জাজ, আমি একজন ফিলিস্তিনি লেখক, আমার বয়স সাতাশ বছর আর আমার অনেক স্বপ্ন আছে।
আমি একটা সংখ্যা নই এবং আমি আমার মৃত্যুর খবর পাশ করাতে সম্মত নই। এটাও বলছি, আমি ভালোবাসি জীবন, সুখ, স্বাধীনতা, শিশুদের হাসি, সমুদ্র, কফি, লেখালেখি, আনন্দদায়ক সবকিছু। যদিও এইসব মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যাবে।
আমার স্বপ্নগুলির মধ্যে একটি হলো- আমার বই আর আমার লেখাগুলি বিশ্ব ভ্রমণের জন্য, আমার কলমের ডানা থাকবে যাতে কোনো স্ট্যাম্পবিহীন পাসপোর্ট বা ভিসা প্রত্যাখ্যান এটিকে আটকে রাখতে না পারে।
আমার আরেকটি স্বপ্ন হলো- একটি ছোট পরিবার থাকবে, আমার মতো দেখতে একটি ছোট ছেলে থাকবে আর আমি তাকে আমার বাহুতে দোল দিতে দিতে শয়নকালের গল্প বলব।’
এখন আমরা যে নিহত ব্যক্তির কথা বলব তাঁর নাম লেখক ও সাংবাদিক মুস্তফা হাসান মাহমুদ আল-সাওয়াফ। তিনি তাঁর পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যসহ নিহত হন। ১৮ নভেম্বর তাঁর বাড়িতে ইসরায়েলি শেল আঘাত হানে। আল-সাওয়াফ ফিলিস্তিনের অন্যতম বিশিষ্ট সাংবাদিক ও বিশ্লেষক। ফিলিস্তিনি রাজনীতির বিষয়ে শত শত লেখা লিখেছেন। তিনি বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ও গাজা উপত্যকায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন।
আল-সাওওয়াফ বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে একটি ছয় খণ্ডের প্রবন্ধের সিরিজ ‘ডেস অফ রেজ (২০০৫)’, আর রাজনৈতিক ছোট গল্পের একটি সংকলন, ‘দ্যায়ার ওয়াজ আ হাউসহোল্ডার (২০১৭)’।
১৬ অক্টোবর খান ইউনিসে নিজের বাড়িতে নিহত হন লেখক আবদুল্লাহ আল-আকাদ। সাথে ছিলেন তার স্ত্রী ও সন্তান।
সেলিম আল-নাফফার ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি যিনি শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের পক্ষে ছিলেন। আর তাঁর কবিতায় ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার ও ইতিহাসে স্মরণীয় হওয়ার সংগ্রামকে প্রকাশ করা হয়েছে। ৭ ডিসেম্বর আল-নাফফার ও তাঁর পরিবার গাজা শহরে তাদের বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। গাজার একটি শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণকারী আল-নাফফার ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় তাঁর পরিবারের সাথে সিরিয়ায় পালিয়ে যান। ১০ বছর বয়সে তাঁর বাবার মৃত্যু হওয়া সত্তে¡ও আল-নাফ্ফার কবিতায় সান্ত¡না পেয়েছিলেন এবং পরে সিরিয়ার তিশরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি সাহিত্য বিষয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে তাঁর পরিবার গাজায় ফিরে আসে। এখানে তিনি আরবি ভাষায় কবিতা সংকলন, উপন্যাস ও একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন।
আল-নাফফার একবার বলেছিলেন, ‘আমি মাঝে মাঝে আমাদের হতাশার গান করি। কিন্তু মানুষ হয়তো আমার কাজ পছন্দ করে কারণ, তা সত্তে¡ও এটা কখনো ঘৃণা বা সহিংসতার ডাক দেয় না।’
এই নিবন্ধের তালিকার শেষ সংযোজন হচ্ছেÑ ফিলিস্তিনি শিল্পী হেবা জাগুত। শিল্পী হেবা গাজী ইব্রাহিম জাগুত যখন নিহত হন তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর। তাঁর ছেলেকে ১৩ অক্টোবর হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরের দিনগুলিতে তিনি তাঁর চিত্রকর্মগুলি প্রদর্শন করেন। আর আবেগের সাথে তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনা করে একটি ভিডিও রেকর্ড করেছিলেন। তাতে তিনি তাঁর স্বপ্নকে প্রকাশ করেছিলেন।
এই যে হত্যাকাণ্ড, হত্যা মিশন-এ থেকে কি ইসরাইলকে নিবৃত করা যাবে না? সময় এসেছে ভাববার। কেন না এইসব শহিদের স্মৃতি বারবার ভেসে উঠছে, আর হৃদয়ে আঘাত করছে। তাঁরা প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে সমাজ রাষ্ট্র সভ্যতার কাছে। যেমনটি কবি সাল আবিল আদিল হুসেইন বলেন-
‘গণহত্যার ছবি ও তাদের কান্না
আমাদের নাড়া দেয় না,
যে ছবিগুলো গাছ ও পাথরকে কাঁদিয়েছে।
সময় এসেছে আমাদের হৃদয় নরম করার,
আমরা ডাকছি… কিন্তু কেউ শুনছে না,
আর কতদিন আমরা মরে পড়ে থাকব…?’