নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে দেশের ৭০ শতাংশ পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে। খাদ্যাভ্যাসের এমন পরিবর্তন পরিবারগুলোকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে ফেলেছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট যৌথভাবে এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে উঠে এসেছে, ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর সময়কালে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্তর গ্রামীণ এবং শহুরে পরিবারগুলোর জন্য একটি প্রধান ধাক্কা ছিল। মূল্যস্ফীতির চাপ ছাড়াও এ সময় কৃষি উপকরণের উচ্চ মূল্য, ফসল, গবাদি পশুর রোগ, পরিবারের সদস্যের উপার্জন হ্রাস, বন্যা, ফসলের কম দাম ইত্যাদির প্রভাব ছিল। এর প্রভাব কাটাতে পরিবারগুলো খাদ্যাভ্যাসের ধরনগুলো অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করেছে। তাছাড়া সঞ্চয় কমে যাওয়া, ঋণ গ্রহণ ছাড়াও বন্ধু বা আত্মীয়দের কাছ থেকে সাহায্য নিতে হয়েছে। এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, মূল্যবৃদ্ধির এই প্রভাবে ৭০ শতাংশ পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে। ৩৫ শতাংশ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হ্রাস করেছে। ২৮ শতাংশ ঋণ গ্রহণ করেছে এবং ১৭ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় হ্রাস করেছে।
সানেমের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিগত তিন দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারি এবং পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের প্রভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি এবং মহামারি-পরবর্তী এসব প্রতিবন্ধকতা বাংলাদেশের দারিদ্র্য, আয় বৈষম্য, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলেছে। এজন্য ‘কোভিড-১৯ মহামারি এবং মহামারি-পরবর্তী প্রতিবন্ধকতা কীভাবে বাংলাদেশের দারিদ্র্য, আয় বৈষম্য, শিক্ষা এবং খাদ্য সুরক্ষার ওপর প্রভাব ফেলছে?’ শীর্ষক গবেষণা পরিচালনা করেছে। সারা দেশের ৫০০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিটে (পিএসইউ) ৯ হাজার ৬৫টি খানাকে এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০২৩ সালের জরিপের প্রশ্নাবলিতে খানার সাধারণ বৈশিষ্ট্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সম্পদ, কোভিড-১৯ জনিত প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং মোকাবিলার কৌশল, সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিনের টিকা দেওয়ার সার্বিক চিত্র, অভিবাসন এবং রেমিট্যান্সের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোসহ কোভিড-পূর্ব, কোভিড চলাকালীন এবং কোভিড-পরবর্তী সময়ে পরিবারের আয় ও ব্যয়ের তথ্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে উঠে এসেছে বাংলাদেশে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার ২০১৮ সালে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে ২১ দশমিক ৬ শতাংশে হ্রাস পেলেও শহুরে দারিদ্র্যের হার ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে, সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার পরিমাপ করা হয়েছে রংপুর ও বরিশালে, যথাক্রমে ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। শহুরে দারিদ্র্য বৃদ্ধির পেছনের দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, নাজুক দরিদ্রদের একটি বড় অংশ শহুরে অঞ্চলগুলোতে বসবাস করে। অর্থাত্ যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকলেও যে কোনো ধাক্কার প্রভাব তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে দিতে পারে। যারা দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচতে অথবা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইত্যাদি কারণে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছিল। সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির মতো উল্লেখযোগ্য ধাক্কাগুলো এই নাজুক লোকদের দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে দিতে পারে। এবং দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো শহুরে এলাকাগুলোকে ব্যাপকভাবে আওতাভুক্ত করে না, যার ফলে অনেক শহুরে পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ থাকে।
ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের হারের পাশাপাশি, এই গবেষণায় দেশে ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্যও লক্ষ করা গেছে। বৈষম্যের পরিমাপক গিনি সহগ ব্যবহার করে দেখা যায়, জাতীয় পর্যায়ে বৈষম্যের হার ২০১৮ সালে ০.৩১ থেকে ২০২৩ সালে কিছুটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৩২-তে। আয়ের পাশাপাশি ব্যয়ের ক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষ করা গেছে।
মহামারি-পরবর্তী সময়ে ঝরে পড়ার হার বেড়েছে
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারি বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন, অনলাইন ক্লাস সুবিধা বিভিন্ন আর্থসামাজিক শ্রেণির শিশুদের মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করেছে। সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশ পরিবার থেকে মাত্র ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিল। সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ পরিবারের ক্ষেত্রে, অনলাইনে অংশগ্রহণের হার ছিল ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ। মহামারি-পরবর্তী পরিস্থিতিতে, এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সি ১৫ শতাংশ শিশু স্কুলে যাচ্ছে না, যা ২০১৮ সালে ১৩ শতাংশ ছিল। এই হার দরিদ্র আয়ের পরিবারের মধ্যে বেশি।
এদিকে করোনা-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয়ও বেড়েছে। ২০১৮ সালের তুলনায়, গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ২০২৩ সালে তিনগুণ বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাসিক ১ হাজার ৭০৪ টাকা। কিন্তু, এই বৃদ্ধি সব আয়ের মানুষের মধ্যে সমান নয়। দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবারের জন্য এই বৃদ্ধি মাত্র দ্বিগুণ ছিল, যেখানে সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ পরিবারের জন্য বৃদ্ধি ছয় গুণ। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশে একটি প্রধান সাফল্য ছিল যথাসময়ে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা। বাংলাদেশে ২৭ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। ৭৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ শতাংশ নারী ভ্যাকসিনের দুটির বেশি ডোজ পেয়েছেন। গ্রামীণ এবং শহরাঞ্চলের মধ্যে ভ্যাকসিনের বিতরণহারের কোনো পার্থক্য নেই।
বেকারত্বের হার বেড়েছে
বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ১৫-২৪ বছর বয়সের মধ্যে এই হার ১২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২৫-৩৪ বছর বয়সের মধ্যে এই হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ। করোনাকালীন যে সব পরিবারে বিদেশ থেকে অভিবাসীর স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে, তাদের মধ্যে ২৯ শতাংশ জরিপকালীন বেকার ছিলেন। এই স্থায়ীভাবে ফিরে আসা অভিবাসীদের বেশির ভাগই জানিয়েছেন যে, তারা মহামারি চলাকালীন চাকরি হারানোর কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। সার্বিকভাবে ২০১৮ সালের তুলনায় বাংলাদেশে সামগ্রিক বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে সামান্য বেড়ে ৪ শতাংশ হয়েছে। যুবকদের বেকারত্বের হারের ক্ষেত্রেও অনুরূপ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়, যা ২০১৮ সালে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে ১১ দশমিক ৬ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গবেষণায় উঠে এসেছে, ৫৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৪ শতাংশ নারী মহামারি চলাকালীন তাদের চাকরি হারিয়েছিলেন। এই শ্রমিকদের বেশির ভাগই তিন-চার মাসের বেশি সময় ধরে বেকার ছিলেন।
সমীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে, পাঁচটি মূল সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত, সারা দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করতে হবে। শহুরে দরিদ্র এবং নব্য দরিদ্র পরিবারের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার কমাতে এবং মহামারির সময়ে শিক্ষা ক্ষতি (লার্নিং লস) পুষিয়ে নিতে শিক্ষা খাতে আরো বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। তৃতীয়ত, সরকারের কর সংগ্রহের আওতা বাড়ানো এবং বিদ্যমান কর কাঠামো পুনর্গঠনের ওপর জোর দিতে হবে। চতুর্থত, পুরুষ, তরুণ এবং স্থায়ীভাবে ফিরে আসা অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার কমাতে সরকারকে আরো সক্রিয় শ্রমবাজার নীতি গ্রহণ করতে হবে। পরিশেষে, গৃহস্থালির মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সরকারকে বিকল্প ও পরিপূরক নীতি গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে বাজার নজরদারি বাড়ানো, প্রধান খাদ্যের আমদানি শুল্ক উদারীকরণ নীতি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অত্যাবশ্যকীয় খাবার যেমন দুগ্ধজাত খাবার, মাংস, ফলমূল ইত্যাদির সরবরাহ বাড়িয়ে দাম নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা উচিত।