Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeঅন্যান্যবাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির সেকাল-একাল

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির সেকাল-একাল

সকল গণতান্ত্রিক দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছাত্র রাজনীতির
প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের প্রথম কাজ পড়ালেখা। পড়ালেখার মধ্যেই ছাত্র রাজনীতি
সম্পৃক্ত হয়ে যায় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে যে, ছাত্র রাজনীতি আর রাজনৈতিক
দলের লেজুড়বৃত্তি কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেকে জাহির করা এক নয়, বরং নীতিগতভাবে সাংঘর্ষিক।

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-তেও জাতীয় রাজনীতি থেকে ছাত্র রাজনীতিকে আলাদা করা হয়েছে। কমিশনে রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে যে সকল শর্ত আরোপ করা হয়েছে তার অন্যতম হলো ‘রাজনৈতিক দলের দলীয় গঠনতন্ত্রে স্পষ্টভাবে বিধান থাকতে হবে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা ছাত্র এবং আর্থিক, বাণিজ্যিক বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার কর্মচারী বা শ্রমিকদের সমন্বয়ে বা অন্য কোনো পেশার সদস্যগণের সমন্বয়ে সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠন না থাকা’- অধ্যায় ৬ক অনুচ্ছেদ ৯০(খ)।

প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির গোড়ার কথা: বিভিন্ন মানব সম্প্রদায় কিংবা সমগ্র মানব সমাজ কীভাবে শান্তিপূর্ণ
সহাবস্থানে বসবাস করতে পারে এবং আত্মিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে সে লক্ষ্যে এরিস্টোটল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ
শতাব্দীতে এথিক্স বা নীতিশাস্ত্র গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। অধিকতর অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে তিনি সহসা অনুধাবন
করেন যে, শুধু নীতিশান্ত্র মানুষের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তখন তিনি রচনা করেন তাঁর
অমরগ্রন্থ ‘পলিটিক্স’। এতে কল্যাণকর সমাজব্যবস্থার জন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। পলিটিক্স বইটি লেখার সময় তিনি সমসাময়িক ১৫৮টি সম্প্রদায় বা নগর রাষ্ট্রের সংবিধান পর্যালোচনা করেছিলেন। প্লেটো সক্রেটিসের ডায়ালগ অনুসরণে খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৫ সালে রচনা করেন ‘রিপাবলিক’।

তাতে নগর রাষ্ট্রের কাঠামোগত বিন্যাস এবং বৈশিষ্ট্য মানুষের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে লেখা হয়েছে। একজন
ন্যায়পরায়ণ মানুষ একজন ন্যায়-নীতি বর্জিত মানুষের চেয়ে বেশি সুখী কিনা তাও তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
দেখেছেন। সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টোটলের চিন্তা ভাবনা থেকেই প্রাচীন গ্রিসে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রাতিষ্ঠানিক
গণতন্ত্রের সূত্রপাত হয়েছিল। প্রায় দুই হাজার বছর পর ভলতেয়ার, রুশো এবং মন্টেস্কুর দর্শন ফ্রান্সের মানুষকে
অনুপ্রাণিত করেছিল ফরাসি দেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্ব বোধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিপ্লব ঘটাতে। আরো পরে মানুষের মুক্তির পথ দেখিয়ে কার্ল মার্কস ১৮৪৮ সালে লিখেছেন ‘দি কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো’।

বিংশ শতাব্দীতে লেনিনের দেশ রাশিয়ায় শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গঠনের প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা করেছিল কম্যুনিজম বা সাম্যবাদ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন- জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের জন্য এবং জনগণের সরকার। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, রাজনীতির মূল লক্ষ্য হলো দেশের জনগণের কল্যাণ।

ছাত্র রাজনীতির স্বরূপ দেশে বিদেশে: যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের ছাত্র রাজনীতির প্রথম কথা
হলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল থেকে দূরে থাকা এবং যদি কখনো সরকার সীমাহীন অন্যায়, অবিচার ও
দুর্নীতিতে লিপ্ত হয় তখন তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করা। ছাত্রদের এই ধরনের আন্দোলন অনেক
দেশে ঘটেছে। যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অংশগ্রহণকে ছাত্ররা অন্যায় হিসেবে দেখেছে। তারা
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ষাট ও সত্তরের দশকে দুর্বার আন্দোলন করেছিল। হাজার হাজার ছাত্র
যুক্তরাষ্ট্রের এক উপকূল থেকে অন্য উপকূলের ক্যাম্পাসমূহে জড় হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ওহাইও অঙ্গরাজ্যের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ১৯৭০ সালের ৪ঠা মে ছাত্রদের এক র‌্যালিতে ওহাইও ন্যাশনাল গার্ডের সৈনিকরা ১৩ সেকেন্ডে ৬৭ রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছিল। তাতে চারজন ছাত্র নিহত এবং নয়জন আহত হয়েছিলেন। এই খবর শোনার পর সারা দেশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং হাই স্কুলের ৪০ লক্ষ ছাত্রছাত্রী রাস্তায় বেরিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ওই বিক্ষোভের ঢেউ বাংলাদেশেও লেগেছিল।

বাংলাদেশের ছাত্ররা শ্লোগান দিয়েছিল- ‘হ্যানয়ে যখন আগুন জ্বলছে, পেন্টাগনেও জ্বলবে’। বর্তমানে ইসরাইল-
প্যালেস্টাইন যুদ্ধ এবং গাজায় ইসরাইলের নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মার্কিন প্রশাসনের নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। ২৭ এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত মোট ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের পক্ষে এই বিক্ষোভ সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ছাত্রদের এই ধরনের আন্দোলন সংগ্রামের গৌরবময় ভূমিকা আমাদের ছাত্র সমাজেরও ছিল। কিন্তু এখন আর একবারেই নেই। পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক মাসের মধ্যে জাতির পিতা জিন্নাহ যখন বলেছিলেন ‘তোমাদের মধ্যে কম্যুনিস্ট আছে, তোমাদের মধ্যে গুপ্তচর আছে, তোমাদের তারা বিভ্রান্ত করছে। আমি বলছি, ভাষার ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন উঠেছে তাতে উর্দু, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ (প্রখ্যাত দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম, একুশের সংকলন, ১৯৮০)।

ওই সময় জিন্নাহর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সমগ্র পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা তিনি। সাধারণ মানুষের পক্ষে জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্যের প্রতিবাদ করা সহজ ছিল না। কিন্তু সেই দুঃসাহসিক কাজটি ছাত্ররা করেছিল। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দিতে সরকার বাধ্য হয়েছিল। আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষার প্রশ্নে, স্বাধীকার, আত্মসম্মানবোধ, বাকস্বাধীনতা এবং জাতীয় লুটপাটের ঘটনা যখনই ঘটেছে তখনই ছাত্রসমাজ, শ্রমিক এবং বেকার যুবকেরা রাস্তায় নেমেছেন। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে বরকত, সালাম, জব্বার, রফিক প্রাণ দিয়েছেন। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মিছিল করতে গিয়ে ১৯৬৯ সালে আসাদ এবং মতিয়ুর শহীদ হয়েছেন। ছাত্ররা সবসময় স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে। তারা কখনো সরকার দলের পক্ষে কথা বলে এমনটা কোনো গণতান্ত্রিক দেশে আছে বলে আমার মনে হয় না।

আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ালেখা করি তখন দেখেছি, ছাত্র নেতারা হলেন ফ্রেন্ডজ অব দ্য ক্যাম্পাস। তারা সারা দুনিয়া থেকে আসা ছাত্রদেরকে স্বাগত জানান। আমাকে প্রায় ৮০ মাইল দূরের কলাম্বাস বিমান বন্দর থেকে ক্যাম্পাসে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। একটি বিশেষ দিনে ক্যাম্পাসে নবীন ছাত্রদের বরণ করেছিলেন। বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদেরকে আনন্দ দিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য কোথায় কী সুবিধা আছে তা অবহিত করেছিলেন। আমার দেশের সঙ্গে যে দেশের ব্যবধান রাত দিনের সে দেশে এসেও খাপ খাইয়ে নিতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। ফ্রেন্ডস অব দ্য ক্যাম্পাস যেন আমার ক্যাম্পাস জীবনের বীণার তার টান টান করে বেঁধে দিয়েছিল। আমি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসে নিজের সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম। আমি একটি সাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষ। অথচ উচ্চ প্রযুক্তির দেশের ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সহজে সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কালচারাল আউটরিচ প্রোগ্রামের স্টুডেন্ট প্রেসিডেন্ট ছিলাম। এটি আহামরি কিছু নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য এই ধরনের অবারিত সুযোগ থাকে। সেই সুযোগ পেয়ে আমিও হয়ে গিয়েছিলাম একজন ছাত্র নেতা। আমার নেতৃত্বের ক্ষেত্র ছিল আমার দেশকে পরিচিত করে তোলা।

আমি একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করেছিলাম হিম শীতল তুষাবৃত ক্যাম্পাসে। আমি ১৯৭৫ সালে সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরি করেছিলাম আমার এক ভাই এক কালের ছাত্রনেতা শফিকুল মওলা এবং পরবর্তীকালে ভাগ্নি জামাই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্রের প্রথম কণ্ঠস্বর এবং ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ গানের রচয়িতা আবুল কাসেম সাহেবের হাত ধরে। তখন একুশের রাতে শহীদ মিনারের উত্তরের দেওয়ালে ভাষা আন্দোলনের পোস্টার, আন্দোলনের কাহিনীসম্বলিত স্কেচ এবং দেয়াললিখন দেখা যেত। ছাত্রদের আঁকা ভাষা শহীদের লাশ হাতে নিয়ে ছাত্রদের মিছিলের একটি ছবি ছিল। আমি ওই ছবির অনুকরণে একজন আমেরিকান ছাত্রের সহযোগিতায় একটি পোস্টার আঁকিয়ে নিয়েছিলাম। নানা রঙের কালিতে মোটা তুলি ব্যবহার করে কয়েকটি বড় বোর্ডে বাংলা বর্ণমালা লিখেছিলাম। ভাষা নিয়ে শ্লোগান লিখে তা ক্যাম্পাসে প্রদর্শন করেছিলাম। আমার প্রদর্শনীতে অনেক ছাত্রছাত্রী এসেছিল। ছাত্রনেতা হিসেবে আমি আমার দেশের জন্য আরো একটি কাজ করেছিলাম সেটি হলো ওহাইও ভ্যালির বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে বাংলাদেশকে পরিচিত করে তোলা। ভাষা শহীদ দিবস উপলক্ষে আমি যে সব প্রদর্শনী পোস্টার তৈরি করেছিলাম সেগুলো বিভিন্ন স্কুলে নিয়ে যেতাম। ভাষা আন্দোলনের কথা আমি ছাত্রদেরকে শুনিয়েছি গল্পের মতো করে। তারা গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনেছে। হঠাৎ ওয়ারেন হাই স্কুল থেকে আমার কাছে একটি অনুরোধ আসে। আমি দায়িত্ব পেলাম জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলনের অনুকরণে বিভিন্ন স্কুলের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য প্রতিযোগিতায় ওয়ারেন হাই স্কুলকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল হিসেবে প্রস্তুত করার জন্য। আমি তা সফলভাবে করতে পেরছিলাম। সম্মানীও পেয়েছিলাম আশাতীত রকমের বড়। তিরিশ বছরেরও বেশি সময় পরে আমি এখনো বিস্মিত হই কীভাবে আমার মতো একজন চলতি মানের লাজুক ছাত্র এতোসব কাজ যুক্তরাষ্ট্রে করতে পেরেছিল। সেটি সম্ভব হয়েছে ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রনেতা এবং ক্যাম্পাসের সুবিধার কল্যাণে। এখনো ওই সব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রাপ্ত সার্টিফিকেট আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমি গর্ব করে বলি- ওহাইও ইউনিভার্সিটি হ্যাজ মেইড মি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট সেন্টারে ছাত্রদের সমাগম থাকতো।

ছাত্রদের নানা রকমের কর্মসূচিতে ঠাসা থাকত বেকার সেন্টার। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, বিভিন্নি দেশের গান, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সেন্টারকে প্রাণবন্ত করে রাখত। প্রতিদিন সেখানে মিলনমেলা বসত। তাতে ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সমাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেত এবং পারস্পরিক বন্ধন তৈরি হতো। আমি বিদেশে ছাত্রদেরকে রাজনৈতিক দলের লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি করতে দেখিনি একটি সময় ছিল যখন আমাদের দেশের ছাত্ররা গৌরবোজ্জ্বল রাজনীতি করেছে। ছাত্র নেতৃবৃন্দ ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে স্বাধীনতার পক্ষে একটি প্রস্তাব পাশ করেছিলেন। দেশের জন্য একটি পতাকাও তারা বানিয়েছিল। ওই পতাকা তখন ঘরে ঘরে উড়েছিল। এমন কী ২৩ শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে এই পতাকাটিই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে উড়ানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গাড়িতেও এটি উড়েছিল। ৩রা মার্চ পল্টনের বিশাল জনসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নেতারা বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন। স্বাধীনতার শপথ নিয়েছিলেন।

ঘোষণা করা হয়েছিল স্বাধীন ও স্বার্বভৌম দেশের নাম হবে- ‘বাংলাদেশ’, জাতীয় সঙ্গীত- ‘আমার শোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। বঙ্গবন্ধু- জাতির পিতা এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সুপ্রিম কমান্ডার। এম এ জি ওসমানী- প্রধান সেনাপতি। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এই যে ঐতিহ্য তাতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধস নামে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। ছাত্র রাজনীতির স্বরূপ দ্রুত পাল্টাতে থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকসুর প্রথম নির্বাচনে ব্যালট বক্স ছিনতাই হয়েছিল। ক্যাম্পাসে হত্যার রাজনীতি চালু হয়েছিল।

১৯৭৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল একটি ছাত্র সংগঠনের অন্তর্কলহের জের ধরে একদল সশস্ত্র কর্মী সূর্যসেন হল থেকে সাতজন ছাত্রকে ঘুম থেকে তুলে অস্ত্রের মুখে মুহসিন হলে নিয়ে এসেছিল। তাদের হাত-পা বেঁধে টিভি কক্ষে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। তারপর স্টেনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে তাদের সাতজনকে হত্যা করেছিল। বলা হয়ে থাকে ঢাকসু ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই খুন সংঘটিত হয়েছিল। অনেক দিন মুহসিন হলের টেলিভিশন কক্ষের দেয়ালে নিহত ছাত্রদের রক্তের দাগ সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে একটি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শেষে অনেকের হাতে তখন অস্ত্র ছিল যা ক্যাম্পাস সন্ত্রাসের অন্যতম কারণ। তবে এটা ঠিক যে সত্তরের দশকে মেধাবী ছাত্ররাই বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে ছিলেন।

আমাদের সময়ে ছাত্রনেতা ছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূহ উল আলম লেনিন, খন্দকার ফারুক হোসেন,
মাহাবুবুল মোকাদ্দেম আকাশ, কাজি আকরাম হোসেন, ওবায়দুল কাদের, বাহালুল মজনুনন চুন্নু, মাহামুদুর রহমান মান্না প্রমূখ তুখোড় মেধাবী ছাত্র ও বক্তা। দলমত নির্বিশেষে তাঁদের বক্তৃতা শুনে আমরা বন্ধুরা আলোচনা করতাম কে কোনো যুক্তিটা বেশি ভালো দিয়েছেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থাকতো তাঁদের বক্তৃতায়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা এই ধরনের ছাত্র রাজনীতি দেখেছি। প্রত্যেক ছাত্র নেতা ছিলেন খুবই সম্মানিত।

কিন্তু আমরা এখন পত্র-পত্রিকায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিরভিন্ন রকমের চিত্র দেখতে
পাই। ছাত্র কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত ন্যায্য দাবি-দাওয়া অনুপস্থিত। ছাত্রদের কল্যাণের কোনো উদ্যোগ
দেখি না। ছাত্রনেতারা এখন আর ফ্রেন্ডস অব দ্য ক্যাম্পাস না হয়ে টেরর অব দ্য ক্যাম্পাস হয়ে গেছে। অনেক
ছাত্র র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ
প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাঁচ বছরে বিভিন্ন পর্যায়ে কমপক্ষে পাঁচবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু
তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ছাত্রনেতাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব শেষ, কিন্তু তারা হলেই থাকেন। আর সাধারণ
ছাত্ররা সিটের অভাবে গাদাগাদি করে এখানে ওখানে থাকছে। এই প্রচণ্ড গরমের মধ্যে একটি কক্ষে একসঙ্গে ১৫ থেকে ২০জন ছাত্র শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতারা হল নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। তাঁরা ঠিক করেন কে হলে উঠতে পারবে, কে পারবে না এবং কে কোন কক্ষে থাকবে। (প্রথম আলো, ২৭-২৮ এপ্রিল ২০২৪)।

পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যকার বিরোধের সচিত্র খবর প্রায় প্রকাশ হয়ে থাকে। দেখা যায় লাঠিসোটা, দা, কিরিচ, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে। তারা খুব ছোটোখাটো কারণে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করছে। জোর করে নিরীহ ছাত্রদেরকে মিছিলে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রস্তাবে রাজী না হলে নানা রকমের বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে পঙ্গুত্ব, এমন কী মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি,পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহিংস আচরণ। এমন কি শততম ধর্ষণ পূর্তির উৎসবও হয়েছে। পরীক্ষায় বছরের পর বছর ফেল করছে। অনেকে আবার অতি হতদরিদ্র পরিবার থেকে এসে বর্তমান ধারার ছাত্র রাজনীতির সুযোগে বিত্তবান হয়ে গেছেন। উপসংহারে বলা যেতে পারে সুস্থ ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদেরকে নিরাপত্তা দেয়। ছাত্রদের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু কোথায় সে ছাত্র রাজনীতি?

ছাত্র রাজনীতি বলতে কোনোকিছু কি আদৌ বাংলাদেশে আছে? এর জন্য দায়ী কে? ছাত্ররা প্রলোভনে পড়ে ভুল
করতে পারে। কিন্তু মানুষ সৃষ্টির কারিগর হিসেবে রাষ্ট্রের অর্থায়নে কর্মরত ভিসি, প্রভোস্ট এবং হাউস টিউটর ভুল করতে পারেন না। আমার মনে হয় না এতো ব্যর্থতা নিয়ে বাংলাদেশের কোনো সরকারি, আধাসরকারি কিংবা স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা সম্ভব। ছাত্র সংসদের নির্বাচন নেই। প্রভোস্ট ও হাউস টিউটর থাকতে ছাত্র নেতারা সিট বরাদ্দ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত দেয়। এসব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, একডেমিক কাউন্সিল এবং
সিন্ডিকেটের অসীম ক্ষমতা রয়েছে। সরকার ভিসিকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি কেন সরকারের কাছে সমস্যাসমূহ উপস্থাপন করে তা তুলে ধরছেন না? একটা সাদামাটা উত্তর হতে পারে শিক্ষকরাও রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে নীল দল, সাদা দলে বিভক্ত হয়ে আছেন বিশেষ সুবিধার মোহে। আমাদের দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তি, রাজনীতির প্রাণপুরুষ মহান ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের অনেকের ছেলেমেয়েরা বিদেশেই পড়েন। তাদের আবার ভাবনা কী? তাদের সন্তানরাই তো বিদেশে থেকে এসে সময়মতো বসবেন বিভিন্ন উচ্চাসনে।

লেখক: লিয়াকত খান, যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। বিশিষ্ট লেখক, অনুবাদক ও টেড হিউজ গবেষক। অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সরকার

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments