Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeস্বদেশ সংবাদবাংলাদেশে শ্রমিক বিক্ষোভ: শতাধিক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ

বাংলাদেশে শ্রমিক বিক্ষোভ: শতাধিক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ

জয় বাংলাদেশ : মজুরি ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন। একই সঙ্গে চাকরিচ্যুত শ্রমিক ও চাকরিপ্রত্যাশীরাও চাকরির দাবির পাশাপাশি নিয়োগে নারী-পুরুষের সমতা চেয়ে সড়ক অবরোধ করেছেন। এ সময় কয়েকটি কারখানায় ভাঙ্চুর করা হয়। এর ফলে সাভার-আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এই অস্থিরতা ওষুধ, খাদ্যসহ বিভিন্ন শিল্পেও ছড়িয়ে পড়ছে।

এ পরিস্থিতিতে শিল্পকারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি অস্থিরতায় ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও শিল্প পুলিশের যৌথ অভিযান শুরু করার নির্দেশনা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা গতকাল সোমবার বিকেলে উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে শিল্পের নিরাপত্তায় শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান। এরপরই যৌথ অভিযানের নির্দেশনা আসে। গতকাল রাত থেকেই যৌথ অভিযান শুরু করার কথা।

শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে গতকাল তৈরি পোশাক, ওষুধ, খাদ্যসহ বিভিন্ন শিল্পের শতাধিক কারখানার উৎপাদন বন্ধ ছিল। বিক্ষোভ শুরুর পর আশুলিয়ায় ৪০টি ও গাজীপুরে ৪৫টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। এর বাইরে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি কারখানা বন্ধ আছে। গতকাল গাজীপুরে ১১টি তৈরি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর হয়েছে। দুটি কারখানায় লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। শিল্প পুলিশ ও বিজিএমইএ এ তথ্য জানিয়েছে। বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল রাকিব বলেন, বর্তমান অস্থিরতার পেছনে একটি গোষ্ঠীর ইন্ধন রয়েছে।

তাদের লোকজন লুঙ্গি পরে, হেলমেট মাথায় দিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে; কারখানা ভাঙচুর করছে। আর নিয়োগে নারী-পুরুষের সমতাসহ যেসব দাবি করছে, সেগুলোর কোনো যুক্তি নেই। উদ্দেশ্যমূলকভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে শ্রমিকনেতা বাবুল আখতার বলেন, গত দেড় দশকে যখনই শ্রমিকেরা অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেছেন, তখনই তাঁদের ভয়ভীতি, হামলা-মামলা ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সে জন্য শ্রমিকেরা ভয়ে চুপ ছিলেন। বর্তমানে পুলিশ প্রশাসন পুরোপুরি কার্যকর নয়, অন্যদিকে স্থানীয় মাস্তানরা দৌড়ের ওপর আছে। এই সুযোগে শ্রমিকেরাও নিজেদের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে শুরু করেছেন। তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিটি কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, সেনাবাহিনী ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আলাদা করে আলোচনায় বসে সমস্যা সমাধান করা দরকার। পাশাপাশি শিল্প পুলিশকে কার্যকর করতে হবে।

আশুলিয়া ও গাজীপুরে অস্থিরতা
ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় গতকাল পোশাক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, শ্রমিক নিয়োগ, আন্দোলনকারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়াসহ ১১ দফা দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন শ্রমিক ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। সকাল নয়টার দিকে পলাশবাড়ী এলাকায় নবীনগর থেকে চন্দ্রাগামী মহাসড়কের এক পাশে বিক্ষোভ শুরু করেন গিল্ডান বাংলাদেশ নামের পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা। এ ছাড়া ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। নরসিংহপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরা আবদুল্লাহপুর থেকে বাইপাইল সড়কে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে শ্রমিকদের আশ্বস্ত করে বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়ক থেকে তাঁদের সরিয়ে দেন।

আশুলিয়ায় শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকেরা ছাঁটাই বন্ধ, হাজিরা বোনাসসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ৩৫-৪০টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছে।

গাজীপুরে গতকাল সকাল সাড়ে নয়টার দিকে চাকরিচ্যুত তিন শতাধিক শ্রমিক কয়েক ধাপে ১০-১২টি পোশাক কারখানার ফটকে অবস্থান নেন। তাঁরা কারখানার কর্মরত শ্রমিকদের আন্দোলনে যোগ দিতে আহ্বান জানান। তবে কর্মরত শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামতে অস্বীকৃতি জানান। পরে চাকরিচ্যুত শ্রমিকেরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।

চাকরিচ্যুত শ্রমিক আবদুল আলীম বলেন, ‘আমরা কয়েক সপ্তাহ আগেও বিক্ষোভ করেছিলাম। কারখানাগুলোতে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আজ চাকরিতে থাকা শ্রমিকেরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। আমাদের দাবি না মেনে নিলে কোনো গার্মেন্টসে শ্রমিকদের ঢুকতে দেওয়া হবে না।’

বিজিএমইএ ও শিল্প পুলিশ জানায়, গাজীপুরের ভ্যালমন ফ্যাশন, ব্রাদার্স ফ্যাশন, স্টাইলিশ ফ্যাশনসহ ১১টি কারখানায় ভাঙচুর হয়েছে। এ ছাড়া ম্যাচটেড ইন্টারন্যাশনাল ও টেক্স ইউরো বিডি কারখানায় লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোশারফ হোসেন বলেন, বিভিন্ন সময় চাকরিচ্যুত কয়েক শ শ্রমিক চাকরিতে বৈষম্য ও পুরুষ শ্রমিকদের নিয়োগে অগ্রাধিকারের দাবিতে ১১টি কারখানায় ভাঙচুর চালান।

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি আমরা সব সময় মালিক-শ্রমিক-সরকার এই তিন পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেছি। শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি থাকলে আমরা সমাধানের চেষ্টা করব। তবে যারা অযৌক্তিক দাবি নিয়ে এই খাতকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

ওষুধ খাতেও অস্থিরতা
বেতন বৃদ্ধি, সপ্তাহে দুদিন ছুটিসহ বিভিন্ন দাবিতে দেশের বিভিন্ন ওষুধ কারখানায় গত ৩১ আগস্ট থেকে শ্রমিক বিক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এর ফলে খাতটিতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে টাঙ্গাইলের কালিয়াকৈরে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি কারখানা এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

জানা যায়, বেতন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে বেক্সিমকো ফার্মা, ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালস, এসিআই ফার্মা, জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালস, জিসকা ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অন্তত ১০টি কারখানায়। এর মধ্যে বেক্সিমকো ও ইনসেপ্‌টার কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখার ঘটনাও ঘটেছে।

ওষুধশিল্পের একাধিক মালিক জানান, শ্রমিকদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে, এমন প্রতিষ্ঠানেও এবার শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। শ্রমিকদের কিছু যৌক্তিক দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়ার পর নতুন দাবি উত্থাপন করা হচ্ছে। যা পূরণ করতে গেলে শিল্প খাতে অসামঞ্জস্য দেখা দেবে। নানাভাবে শ্রমিকদের আশ্বস্ত করার পরও কোথাও কোথাও একটি গোষ্ঠী শ্রমিকদের আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছে।

স্কয়ার ফার্মার নির্বাহী পরিচালক (ফিন্যান্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমাদের দুটি কারখানার মধ্যে টাঙ্গাইলের কারখানাটি গত ৩১ আগস্ট থেকে বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন দাবি নিয়ে আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। ন্যায্য দাবি পূরণের আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কারখানায় উৎপাদন শুরু করা হবে।’

প্রাণ-আরএফএলের উৎপাদন ব্যাহত
ন্যূনতম বেতন ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ, হাজিরা বোনাস ও ঈদের ছুটি বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবিতে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ছয়টি অঞ্চলের কারখানার শ্রমিকেরা গতকাল সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন। এতে কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

জানা যায়, গত রোববার হবিগঞ্জের অলিপুরের হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের একাংশের শ্রমিকেরা কর্মবিরতি শুরু করেন। শ্রমিকদের এই কর্মবিরতি গতকাল নাটোর, দিনাজপুর, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, নরসিংদীর পলাশ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জের কারখানাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।

শ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে এক দিনেই প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রায় ১০০ কোটি টাকার উৎপাদন লোকসান হয়েছে বলে জানান গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল। তিনি বলেন, শিল্পকারখানায় অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া দরকার।

 

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments