কবি আকমল হোসেন ফোন করলেন। এই সময়ে তার ফোন করার কথা নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মেপে ফোন করলে আগস্ট মাসে ফোন করার কথা। কিন্তু ফেব্রুয়ারির পনের তারিখে তার ফোন করার কারণ হলো ‘সপ্তম ঋতু’।
আকমল হোসেন এক হাজার পাঁচশত পংক্তির একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি তিনি এক হাজার সাত’শ টাকা খরচ করে কম্পোজ করিয়েছেন। এখন তার ইচ্ছে, এটি ঢাকার কোনো প্রকাশকের হাতে পড়ুক। এক ভদ্রলোক বলেছেন, চ্যানেল না ধরলে তুমি প্রকাশক পাবা না। তখন তার মনে পড়েছে আমার কথা।
আমার কথাও তার মনে পড়ার কথা নয়। তার বোতাম মোবাইলে আমার নাম্বারটি কোনো একদিন সংরক্ষণ করেছেন ‘চ্যানেল’ নাম দিয়ে। তিনি ‘চ্যানেল’ ধরার অংশ হিসেবে আমাকে ফোন করেছেন। কোনো এক সময়ে আমি কবি আকমল হোসেনের নাম্বারটি সঠিক নামেই আমার মোবাইলে সংরক্ষণ করেছিলাম। আজ যখন ফোন করলেন, দুইবার আমি ফোন ধরলাম না। তৃতীয়বার ধরলাম। তার নাম স্পষ্ট ভাসলো আমার মোবাইলে কিন্তু চেহারাটা মনে করতে পারলাম না। এমন এক কাজে ছিলাম, যার মধ্যে কোনো কবি ঢুকে পড়লে ঝামেলা।
কবি আকমল হোসেন যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বুঝে ফোন করতেন তাহলে আগস্ট মাসে তার ফোন করার কথা। এই বাক্যটি পাঠকের পক্ষে বুঝে ওঠা সহজ নয়। আমি তাৎক্ষণিক সহজে বুঝে গেলাম। মশকরা করে বললাম, আপনি আগস্ট মাসে ফোন করবেন। তিনি বেশ আনন্দ পেলেন। নতুন কথার জো পেলেন। বললেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ওপর এমন কবিতা পৃথিবীর কেউ লেখে নাই। আমার কবিতাটিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। এটি ছাপানোর জন্য কিছু খরচ-পাতি করবো। আমি বললাম, কত দেবেন? বললেন, আমি গরীব মানুষ। টাকা পয়সা খরচ করার মতো নাই। কিছু টাকা আপনাকে দিব। বললাম, কত? তিনি বললেন, আমার সাধ্যে যা কুলায়।
কবি আকমল হোসেনের নিজস্ব সৃষ্টির প্রতি অপরিমেয় বিশ্বাস দেখে অবাক হলাম। কথার জো পেয়ে গেলাম। না বুঝেই বললাম, আপনি স্থানীয় পত্রিকায় কবিতাটা ছাপেন? তিনি হাসলেন। বললেন, এত বড় কবিতা কিডা ছাপবে? আমি বললাম, কিস্তিতে ছাপেন। ধারাবাহিকভাবে। তিনি জোরে হাসলেন। বললেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা কিস্তিতে ছাপালি মান সম্মান থাকে? তার আত্মবিশ্বাসে আমি এবার রীতিমত সন্তুষ্ট। বললাম, ভাই আমার ঠিকানাটা রাখেন। আপনার পাণ্ডলিপিটা ফটোকপি করে পাঠান। আমি বই ছাপার ব্যবস্থা করবো। টাকা পয়সা লাগবে না। কবি আকমল হোসেন, কিছুটা অস্থির ও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বুঝলাম, ভেতরে তার এক ধরনের শিহরণ কাজ করছে। বললাম, বই বের হলে কী করবেন? তিনি বললেন, কিছু না। আমার বইটি প্রকাশ হলে, গরীবের একটা চিন্তা আলোর মুখ দেখলো, এই আর কি!
বই সারাবছর পড়ার জিনিস। সবসময়ের ফল-ফসল ও খাদ্য এটি। এর অপরিহার্যতার কোনো দিনক্ষণ থাকে না। কিন্তু একটি মৌসুমে বই প্রকাশের ধুম পড়ে যায়। এই মৌসুমে মানুষ বইকে ঘিরে স্বপ্ন দেখে। নিজস্ব সৃষ্টি ও চিন্তাকে আলোর মুখ দেখানোর জন্য ভেতরে তাড়া কাজ করে। ঈশ্বরদীর কবি আকমল হোসেন এই সময়েই বইটি প্রকাশ করার স্বপ্ন দেখছেন। তার স্বপ্নটি বাস্তব করার মতো প্রকাশক পাওয়া যাবে কি-না জানিনা। তবে আমি চেষ্টা করবো।
আমাদের দেশে কবি আকমল হোসেনের সংখ্যা কম নয়।যাদের সৃষ্টির নেশা আছে। সুগভীর আত্মবিশ্বাস আছে নিজের লেখা নিয়ে। তারা বিশ্বাস করেন নিজের লেখা দিয়ে দিগ্বিজয় করবেন, কিন্তু নানা কারণেই পারেন না। এখন সবকিছু বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। হতে হয়েছে। বাণিজ্যেই ভরসা। সেকথাও ঠিক; বাণিজ্যিক প্রকাশকেরা তো আকমলের স্বপ্ন ধুয়ে পানি খাবে না!