এক
‘পৃথিবীর প্রথম কবিকে কে কবিতা লেখা শিখিয়েছে?’ এইরকম কথা যারা বলেন, তাদের বলার মধ্যে এমন একটা ঔদ্ধত্য দেখতে পাই, মনে হয় যারা কবিতার ব্যাকরণ-প্রকরণ শেখার কথা বলেন তারা নিতান্তই কবিতা-মূর্খ। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো নিজেদের অজ্ঞতা এবং শেখার অনাগ্রহ আড়াল করার জন্যই তারা এসব কথা বলেন।
এ যাবৎ আমরা যেসব প্রাচীন কবির কথা জেনেছি তাদের মধ্যে মেসিপটেমিয়া সভ্যতার আক্কাদ সম্রাট সারগন ও তার স্ত্রী তাশলুলতুমের কন্যা এনহেদুয়ানাই পৃথিবীর প্রথম কবি। এনহেদুয়ানা কি জানতেন তিনি কবিতা লিখেছেন? না, তিনি দেবী ইনানার স্তুতি করে কিছু কথা বলেছেন, সেইসব কথাগুলো কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে পাথরে খোদাই করে লিখেছেন। কালক্রমে বোদ্ধারা, পণ্ডিতেরা সেইসব কথা উদ্ধার করে ঘোষণা করেন, এগুলো হচ্ছে কাব্যশ্লোক, মানে কবিতা। এসব কথার মধ্যে ছন্দ আছে, ইঙ্গিত আছে, প্রেম আছে, সমর্পণ আছে, প্রার্থনা আছে, যা আদি কবিতার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
কালক্রমে আমরা যখন জানলাম ছন্দ কবিতার একটি প্রধান উপকরণ, তখন ছন্দকে গাণিতিক শুদ্ধতার ছাঁচে ফেলে একটি ফর্মূলা তৈরি করে নিলাম। পরবর্তিতে এই ছাঁচে ফেলে দেখা গেল অনেক প্রাচীন কবিতাই পুরোপুরি শুদ্ধ ছন্দে রচিত হয়নি। কারণ তারা এই গাণিতিক শুদ্ধতা জানতেন না। যেমন বাংলা ভাষার প্রাচীন কবিতা চর্যাপদে ব্যবহৃত মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রচুর অশুদ্ধতা রয়েছে। অশুদ্ধতা থাকাই স্বাভাবিক, কারণ চর্যাপদের কবিরা ছন্দের ব্যাকরণ জানতেন না। তাদের অন্তরে যে প্রাকৃতিক ছন্দ ছিল সেই ছন্দেই তারা লিখেছেন, সেখানে বৈজ্ঞানিক শুদ্ধতার অভাব থাকতেই পারে। কিন্তু যখন আমরা বৈজ্ঞানিক শুদ্ধতা শিখে ফেলেছি তখন কি আর শুদ্ধ/অশুদ্ধ প্রাকৃতিক ছন্দে কবিতা লিখব?
একজন বাউল বাংলার পথে পথে হাঁটেন আর গান করেন। তিনি সারগাম শেখেননি, মনের খেয়ালে গান করেন। সেই গান আমাদের শুনতে ভালোও লাগে কিন্তু সেই গানের তালে, সুরে, ছন্দে, লয়ে প্রচুর ব্যাকরণগত ভুল থাকে। যখন আমরা পেশাদার স্টুডিওতে সেই গানটি একজন পেশাদার আধুনিক শিল্পীর কণ্ঠে নির্মাণ করি তখন ত্রুটিগুলো শুধরে নিয়ে ব্যাকরণ সম্মত তাল, লয়, ছন্দেই তৈরি ও পরিবেশন করি।
যিনি প্রথম রেডিও বানিয়েছেন, যিনি প্রথম কম্পিউটার বানিয়েছেন, যিনি প্রথম অ্যারোপ্লেন বানিয়েছেন তারা আমাদের নমস্য, যেমন নমস্য লুই পা, সবর পা, কুক্কুরি পা’র মতো চর্যাপদের লেখকেরা কিন্তু তাদের প্রথম নির্মাণের ত্রæটিগুলো থেকে আমরা কি প্রতিনিয়ত উত্তরণ ঘটাইনি? এখন কি আমরা প্রথম বিমানের মতো বিমান বানাই? বানাই না। কারণ আমরা এখন আরো উন্নত বিমানের প্রযুক্তি [মানে ছন্দ] শিখে গেছি।
আজকের কবি, একজন আধুনিক ও বিজ্ঞান মনস্ক কবি, কিছুতেই একথা বলবেন না যে পৃথিবীর প্রথম কবিকে কে শিখিয়েছে কবিতা লেখা? কবিতা হাজার হাজার বছরের অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে আজকের কবি হিসেবে আমাকে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে।
আপনি যদি মনে করেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম উদ্দিন, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদরা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ করি, তাদের চেয়ে ভালো কবিতা লেখা সম্ভব নয় এবং আমি তাদেরই অনুসরণ করবো, তাহলে আপনি প্রথমেই আত্মসমর্পণ করলেন এবং নিজেকে একজন ব্যর্থ কবি হিসেবে স্বীকার করে নিলেন। কবি হিসেবে আপনার প্রধান কাজ হলো পূর্বসূরীদের অপূর্ণতা খুঁজে বের করা এবং তা পূর্ণ করা। আপনি যদি তাদের চেয়ে উন্নত কবিতা লিখতে না পারেন তাহলে আজকের পাঠক কেন আপনাকে পড়বে? আপনি যদি নজরুলের কবিতাই লিখেন তাহলে পাঠক কেন নকল নজরুল পড়বে যখন আসল নজরুলই তাদের লাইব্রেরিতে রয়েছে?
আমি একবার বলেছিলাম কবি হিসেবে আমার উচিত হবে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা। অনেকেই এতে আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এই অস্বীকারের অর্থ তাকে অশ্রদ্ধা করা নয়, তার কবিতাকে আমার কবিতার পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা বা বাতিল করা। আমাকে এমন কবিতা লিখতে হবে যা তিনি লিখতেই পারেননি কিন্তু পাঠকের কাছে এই নতুন কবিতার কদর রয়েছে। আমি বলেছিলাম, আমাদের আজকের রাজনীতিবিদদের উচিত হবে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানের চেয়ে বড়, বিচক্ষণ, উদার, দেশপ্রেমিক ও নৈতিক নেতা হওয়ার চেষ্টা করা। আমরা যদি মেনে নেই যে তাদের চেয়ে বড় নেতা হওয়া সম্ভব নয়, তাহলে দেশ এগুবে কী করে? ঠিক তেমনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের চেয়ে ভালো এবং শুদ্ধ কবিতা যদি আজকের কবিরা লিখতে না পারেন তাহলে বাংলা কবিতা এগুবে কী করে?
দুই
কেন রবীন্দ্রনাথ বাতিল?
আমি রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করতে বলেছি বলে অনেকেই ক্ষেপেছেন। রবীন্দ্রনাথ এখানে শুধু লেখক রবীন্দ্রনাথ নন, তিনি একটি সময়ের প্রতীক, পুরাতনের প্রতীক। পুরাতনের প্রতীক হিসেবে যদি কারো নাম নিই তো এমন কারো নামই তো নিতে হবে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। এটা নিশ্চয়ই আজ আর ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হবে না কেন রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ। তিনিই তো ভদ্র সমাজের প্রতিদিনের ব্যবহারের উপযোগী করে বাংলা ভাষাটিকে নির্মাণ করেছেন, গদ্যে, পদ্যে এবং গীত রচনায়, এই ত্রিধারায় ভাষার কৌলিন্য ঠিক রেখেই ভাষাটিকে সহজ করে আমাদের ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছেন।
জীবনানন্দ দাশ অনেক বড় কবি বটে কিন্তু তাকে কি আমরা আমাদের প্রতিদিনের যাপিত জীবনে, উৎসব পার্বণে, ধর্মে, পূজায়, জন্ম-মৃত্যুর আয়োজনে-আনুষ্ঠানিকতায়, বিবাহে, দূরের যাত্রায়, শুভ-অশুভ মুহূর্তের স্মরণে পাই? পাই না। বাঙালির প্রতিদিনের যাপনে কাকে আমরা পাশে পাই? নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথকে। যদিও তারও একটি বড় শূন্যতা আছে, সেটি হচ্ছে, দুই বাংলার ২০ কোটি বাঙালি মুসলমান তাদের উৎসব পার্বণে রবীন্দ্রনাথকে পায় না। এই সংকীর্ণতা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন এবং এর দায় তাকে নিতেই হবে। সেই দিক থেকে কাজী নজরুল ইসলাম অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ যদিও তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে পারেননি, এজন্য অবশ্য তিনি মোটেও দায়ী নন, দায়ী প্রকৃতি। প্রকৃতিই তাকে ৪২ বছর বয়সের সৃষ্টিসীমায় বেঁধে দিয়েছেন, অথচ তখনই তার কাছ থেকে আরো অধিক পরিণত সাহিত্য বাঙালিরা পেতে পারত। কাজেই নজরুলের সীমাবদ্ধতার দায় আমরা নজরুলকে দেব না।
একজন পাঠক হিসেবে অন্য সব বাঙালির মত আমিও রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করি, বুঝার চেষ্টা করি, বিশ্লেষণ করি এবং তার অসম্পূর্ণতা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। আমি তো পড়ি একজন লেখকের পাঠ, পাঠকেরা পড়েন আনন্দ-তৃষ্ণায়। লেখকের পাঠে আনন্দ-তৃষ্ণার চেয়ে অন্বেষণ থাকে অনেক বেশি। পড়তে পড়তে লেখক ভাবেন লেখার সকল উপকরণের সর্বোচ্চ বিন্যাস ঘটেছে কি-না, কোথাও ঘাটতি আছে কি-না, এখান থেকে কিছু আহরণ করা যায় কি-না যা তার নিজের সৃজনশীলতাকে সমৃদ্ধ করবে, কিছু গ্যাপ রয়ে গেছে কি-না যা লেখক হিসেবে তিনি পূরণ করতে পারবেন, ধারাবাহিক উত্তরণে তিনি কীভাবে নতুন ইটের গাঁথুনিটা দেবেন, এইসবই লেখকের পাঠে গুরুত্ব পায়।
শ্রোতা হিসেবে আমি যেসব গান শুনতে পছন্দ করি রবীন্দ্রনাথের গানই তালিকার শীর্ষে থাকে, এরপর লালন, হিন্দি-উর্দু গজল, লোকজ গান, নজরুলের কিছু গান। কিন্তু আমি যদি গান লিখি কিছুতেই রবীন্দ্রনাথের গান লিখব না, খুব সযতনে তখন আমি রাবিন্দ্রীক শব্দগুলোকে বাতিল করে দেব।
ঠিক একই কাজ আমি করি কবিতা লেখার সময়। আমার ছন্দে, আমার শব্দে, আমার উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারে, আমার অনুপ্রাসে আপ্রাণ চেষ্টা করি তা যেন কিছুতেই রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ না করে। আবারও বলি, এখানে রবীন্দ্রনাথ মানে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, রবীন্দ্রনাথ মানে আমার পুর্বপুরুষেরা।
বাঙালি সমাজে রবীন্দ্রনাথের আবেদন এবং প্রয়োজন খুব সহসাই ফুরোবে না, আমার ধারণা তা কোনোদিনই ফুরোবে না। সাধারণ মানুষ আরো বহু বহু শতাব্দী ধরে রবীন্দ্রনাথ চর্চা করবে, তিনিই ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, আধুনিক বাঙালি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার কবিতা যদি আরো বহুকাল মানুষ নাও পড়ে, তার গল্প উপন্যাস যদি আরো বহুকাল নাও পড়ে, তার গান অনন্তযৌবনা, বাঙালিরা তা কোনোকালেই বিস্মৃত হবে না।
একটি সভ্য জাতির উৎসব-পার্বণে, জাতীয় দিবসগুলোতে, প্রেমে-প্রণয়ে, বিয়ে-জন্মদিনে, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে, ধর্মে এবং জিরাফেও সাহিত্য দরকার হয়। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায় যার দিকে হাত বাড়ালে ব্যর্থ হতে হয় না তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কাছেও অনেকটাই পাওয়া যায়। কাজেই এই দুই মহীরূহকে বাঙালিরা খুব সহসাই ভুলে যাবেন না। সাধারণ পাঠক আনন্দ-তৃষ্ণায়ও তাদের পড়বেন, লেখকেরা অতীত জানার জন্য, কাল বুঝার জন্য, দর্শন ও মনস্তত্ত¡ বুঝার জন্য, এবং অপূর্ণতা খোঁজার জন্য তাদের পড়বেন কিন্তু কিছুতেই তাদের মত করে লিখবেন না। লেখক হিসেবে যখনই তিনি কলম ধরবেন তখনই রবীন্দ্রনাথ বাতিল। যদি এ-কালের কোনো লেখক রবীন্দ্রনাথকে [অর্থাৎ পূর্বসূরীদের] অতিক্রম করে নতুন লেখা উপহার দিতে পারেন তবেই তিনি লেখক হিসেবে দাঁড়াবেন এবং বাংলা সাহিত্য এগিয়ে যাবে। তবে একটা বিষয় অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে এই নতুন সাহিত্য, নতুন কবিতা যেন প্রকৃত অর্থেই সাহিত্য বা কবিতা হয়ে ওঠে।
কোনটা সাহিত্য হয়ে উঠল আর কোনটা সাহিত্য হয়ে উঠল না তা হয়তো কেউ আপনাকে বলে দেবে না, এটা আপনি লেখক হিসেবে নিজেই বুঝতে পারবেন। হাজারও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যেও জীবনানন্দ দাশ ঠিকই বুঝেছিলেন তিনি যা লিখছেন তা মহৎ সাহিত্য। এই আত্মবিশ্বাস অর্জনের জন্য আপনাকে পূর্বসূরীদের সাহিত্য ধারাবাহিকভাবে পাঠ করতে হবে, বুঝতে হবে, আত্মস্থ করতে হবে। প্রয়োজনে আপনি যে শাখায় কাজ করছেন (কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি) সেই শাখায় বিশ্বসাহিত্যের কোথায় কি কাজ হয়েছে এবং এখন হচ্ছে তা জেনে নিতে হবে। তখনই মহাকালের আয়নায় আপনি নিজের মুখটি স্পষ্ট দেখতে পাবেন।
তিন
রবীন্দ্রনাথের কী কী বাদ দেবেন
অন্য বেশ কিছু বিষয় মাথায় আছে, ভাবছি অন্যত্র প্রবেশের আগে এই বিষয়টা শেষ করি। একটা কথা স্পষ্ট করে বলি, এই সিরিজের পরামর্শগুলো শুধু এই প্রজন্মের কবিদের জন্য, পাঠকের জন্য নয়, বাঙালি সমাজের জন্য নয়। তবে অন্যরাও জেনে নিতে পারেন। মন্তব্য করতে পারেন, আলোচনা-সমালোচনাও করতে পারেন।
রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়েছিলেন ত্রিশের দশকের কবিরা, তারই জীবদ্দশায়। এবং তাদেরকে প্রথমে অপছন্দ করলেও পরে রবীন্দ্রনাথ যখন দেখলেন বাংলা কবিতার অঙ্গনে ইউরোপীয় ধারার এই প্রবাহকে আর ঠেকানো যাবে না, তখন তিনি নিজেই নিজেকে প্রত্যাখ্যান করে ছোকরাদের মতো ফ্রি ভার্সে বেশ কিছু কবিতা লিখে দেখিয়ে দিলেন, ওসব আমিও পারি। তার ‘পুনশ্চ’ গ্রন্থের তেমন একটি কবিতা ‘বাঁশি’ আজো আবৃত্তিকারেরা গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েন। ‘লিপিকা’ গ্রন্থের ছোট ছোট গদ্যাংশকে মুক্ত গদ্য বললেও আজকের পরিভাষায় সেগুলোও আসলে প্রচলিত ছন্দ-মুক্ত কবিতাই। এই ধারায় তিনি ‘শেষ সপ্তক’ গ্রন্থটিও রচনা করেন। যারা রবীন্দ্রনাথের এই তিনটি গ্রন্থ পড়েননি তাদের অনুরোধ করবো বই তিনটি পড়ে নেবেন।
এখন কথা হচ্ছে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপকেরা রাবীন্দ্রিক কাব্যভাষা পরিহার করে কতটা সফল হয়েছেন? আমরা কি বুদ্ধদেব বসুর কোনো কবিতা চট করেই মনে করতে পারি? মানুষের মুখে মুখে অমিয় চক্রবর্তীর কোন কবিতাটা শোনা যায়? ক’জন আবৃত্তিকার বিষ্ণু দে’র কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা আবৃত্তি করছেন? ব্যতিক্রম শুধু পঞ্চপাণ্ডবের একজন, তিনি জীবনানন্দ দাশ।
ত্রিশের কবিরা রবীন্দ্রনাথের কী বাদ দিয়েছিলেন? তারা ক্রিয়াপদের সাধুরীতিকে চিরতরে বাদ দিয়ে চলিত রীতি স্থাপন করেন, অন্তান্যুপ্রাস পরিহার করেন, কিছু রাবীন্দ্রিক শব্দ, যেমন: মোর, মোদের, মম, ইত্যাদি তুলে দিয়ে কবিতাকে গীতলতার দায় থেকে মুক্তি দিন। বিষয়বস্তু নির্বাচনের দিক থেকেও বৈচিত্র আনেন, আবেগী বিষয়ের চেয়ে বাস্তবিক বিষয়, আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের ঘটনাবলী কবিতায় তুলে আনার দায় অনুভব করেন। এর ফলে কবিতার শরীর কিছুটা রুখো হয়, কবিতাগুলো পড়তে অন্যরকম লাগে। বিশাল এক বৃক্ষের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে ক্ষুদ্র তৃণবৃন্দের মাথা তুলে দাঁড়ানো সহজ কাজ ছিল না। তাদেরকে সর্বদা সচেতন থাকতে হয়েছে, কিছুতেই যেন সেই ছায়ার মায়া আবারও বৃত্তের ভেতরে বাংলা কবিতাকে টেনে নিয়ে না যায়।
কাজী নজরুল ইসলাম বয়সে পঞ্চপাণ্ডবের সামসময়িক হলেও তিনি কবি হয়ে উঠেছিলেন তাদের কিছুকাল আগেই, কুড়ির দশকে, এবং তিনি রবির আলোবৃত্তের মধ্যেই প্রদোষের স্নিগ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে তীব্র রোষে জ্বেলে দিয়েছিলেন দুপুরের প্রখর সূর্যালোক, যে আলোয় রবীন্দ্রাঙ্গ ঝলসে গিয়েছিল বৈকি। কিন্তু নজরুলের এই ভাষার ধারাবাহিকতা তৈরি হয়নি বলে তিনি হয়ে পড়লেন রবীন্দ্রাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু নিকটবর্তী একটি দ্বীপ।
বুদ্ধদেব বসুরা কিন্তু বাংলা কবিতার একটি নতুন মহাদেশই তৈরি করতে পেরেছিলেন। এই মহাদেশ পঞ্চপাণ্ডবেরই আবিষ্কার তবে তা বিস্তৃত হয়েছে এই পথে ক্রমাগত হাঁটতে থাকা আরো শত শত কবির পদচারণায়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ আলী আহসান, সিকান্দার আবু জাফর, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সমর সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবিদ আজাদ, জয় গোস্বামী, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মাসুদ খান, রেজাউদ্দিন স্ট্যালিন, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, টোকন ঠাকুর, কামরুজ্জামান কামু প্রমূখ কবি বাংলা কবিতার এই নতুন মহাদেশ বা রবীন্দ্র উত্তরকাল তৈরি করেছেন।
নতুন এই ভূখণ্ডের প্রথম সফল কবি জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ দাশের সকল কবিতাই কি সফল? না, তার সবচেয়ে সফল কবিতা হচ্ছে ‘বনলতা সেন’। বলা যায় পাঠকের জন্য এটিই জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভুবনে প্রবেশের দরোজা। শুধু জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভুবনে নয়, বাংলা কবিতার যে নতুন মহাদেশের কথা বলছি সেই মহাদেশে প্রবেশেরই স্বর্ণতোরণ এই কবিতাটি।
আমরা যদি এই কবিতাটিকে বিশ্লেষণ করি তাহলেই পেয়ে যাব রবীন্দ্রনাথের কী রাখব আর কী বর্জন করব। মানে রবীন্দ্র উত্তরকালের পাঠকেরা রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাষার বাইরে কতটুকু গ্রহণ বা অনুমোদন করেছেন। বনলতা সেন কবিতাটি শুদ্ধ পয়ারে মানে মধ্যযুগের অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত তবে তিনি পঙক্তি বড়-ছোট করে ফ্রি-ভার্সের সুযোগ নিয়েছেন। শুদ্ধ অন্তান্যুপ্রাস ব্যবহার করেছেন, এমন কী মধ্যান্যুপ্রাসও ব্যবহার করেছেন। ক্রিয়াপদে চলিত রীতির সঙ্গে সাধু রীতিরও কিছুটা মিশেল দিয়েছেন। মিথের ব্যবহার করেছেন। কাল ভ্রমণের চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। নতুন উপমা তৈরি করেছেন, দীর্ঘ হতাশার মধ্যেও এই কবিতায় জ্বলে উঠেছে আশার আলো। এসবই রবীন্দ্র উত্তরকালে বাংলা কবিতার সফল উপকরণ।
কালক্রমে, গত নব্বই বছরে, আরো কিছু পরিমার্জন ঘটেছে, যেমন জীবনানন্দ দাশের মতো উপমা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘মতো’ শব্দটি সম্ভব হলে পরিহার করা, ক্রিয়াপদের বাহুল্য কমিয়ে কবিতাকে মজবুত করা, বিশেষণের আধিক্য কমিয়ে কবিতার মেদ ঝরিয়ে ফেলা, একই কবিতায় শব্দের পৌনঃপুনিক ব্যবহার না করা, দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষাকে কবিতায় প্রতিস্থাপন করা ইত্যাদি।
আমি অনেক জ্যেষ্ঠ কবিকে বলতে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে বাদ দিব? তাহলে লিখব কী? রবীন্দ্রনাথ কোন বিষয়টা লেখেননি? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, নতুন বিষয়ে লেখার চেষ্টাই আমাদের করতে হবে তবে নতুন বিষয় যদি পাওয়া না যায় তখন লক্ষ্য রাখতে হবে উপস্থাপনটা যাতে নতুন হয়। বাঙালি কবিরা এখনো কবিতার বিষয় নির্বাচনে অতি আবেগী: দেশ, ঋতু, প্রকৃতি, পৃথিবী, আধ্যাত্মিক চিন্তা, মহাজগত, মৃত্যু, পরকাল, ইতিহাস এসবের মধ্যেই ঘুরপাক খাই। খুব বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকতে শুরু করি। ফলে পূর্ববর্তী কবিদের বিষয়ের সঙ্গে মিলে যায়। আমি দেখেছি জাপানি কবিরা, কিছু মার্কিন কবিও খুব ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে কবিতা লেখেন, ফলে তাদের বিষয়গুলো মৌলিক হয়।
একটি ভালো বিষয়, ভালো বক্তব্য, ভালো দর্শন কবিতায় থাকতেই হবে, এমন নয়, যা থাকতে হবে তা হচ্ছে পাঠকের ভালো লাগা বোধ। কবিতাটি পড়েই যেন মনে হয় ‘ওয়াও’। হয়তো আমি কিছুই বুঝলাম না, কোন দিক নির্দেশনাই পেলাম না, কিন্তু আমার ভালো লাগল, এটিই হচ্ছে আজকের কবিতা। নতুন এবং অর্থপূর্ণ চিত্রকল্প নির্মাণের চেষ্টা করতে হবে, নতুন উপমা তৈরি করতে হবে। চাঁদকে রুটি তো সুকান্তই মনে করেছেন, আমিও যদি তাই মনে করি তাহলে আমার কবিতা পড়ার দরকার কী? আমাদের কাজ হলো চাঁদের নতুন কোনো উপমা তৈরি করা। জীবনানন্দ দাশের আগে তো কেউ প্রিয়ার চোখে পাখির নীড় দেখেননি। রফিক আজাদের আগে আর কেউ বলেননি প্রতীক্ষা শব্দটি শুধু প্রিয়তমার জন্য, মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার নিজেই একটি কবিতা, একথা তো আল মাহমুদই প্রথম বলেছেন। আর একারণেই এই উপমাগুলো, চিত্রকল্পগুলো পাঠকের এতো ভালো লেগেছে।
আমি বারবারই রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেবার কথা বলছি, প্রকৃতপক্ষে আমি বলছি পূর্বসূরীদের বাদ দেবার কথা। তাদের আমরা বারবার পাঠ করব কিন্তু তাদের কবিতা আমরা লিখব না, লিখব আমাদের কবিতা। মাঝে-মধ্যে আমার অসংখ্য কবিতার মধ্যে দু’চারটি কবিতা পূর্বসূরীদের ভাষায় লিখতে পারি, কিন্তু সেটিই যেন আমার কবিতার প্রধান ভাষা হয়ে না ওঠে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ত্রিশের কবিদের ভাষায় কিছু কবিতা লিখেছিলেন কিন্তু এইসব কবিতার স্থায়ীত্ব নিয়ে তার সন্দেহ ছিল বলেই সেখান থেকে দ্রুতই বেরিয়ে এসেছেন, ফিরে গেছেন নিজের ভাষায়।
আমি মনে করি শুদ্ধ ছন্দে কিছুকাল গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে চর্চা করার পরে ফ্রি ভার্সে লিখতে পারেন, তবে সারাজীবন শুদ্ধ ছন্দে লিখলেও ক্ষতি নেই। অনিয়মিত অন্তান্যুপ্রাস ব্যবহার করতে পারেন, মধ্যানুপ্রাস কিংবা অপূর্ণ অন্তান্যুপ্রাস ব্যবহার করতে পারেন, অন্ত এবং আদি অনুপ্রাস তৈরি করতে পারেন। উপমা এবং চিত্রকল্পের বিষয়ে সবসময় নতুন কিছু উপস্থাপন করবেন। আগের কবিরা যেসব শব্দ অধিক ব্যবহার করেছেন, যেগুলো তাদের ব্র্যান্ডিং হয়ে গেছে, সেসব শব্দ পরিহার করবেন। যেমন জীবনানন্দ দাশ বহু কবিতায় ‘হাজার বছর’ লিখেছেন, এই শব্দযুগল পারতপক্ষে ব্যবহার করবেন না।
লেখক: কাজী জহিরুল ইসলাম