জয় বাংলাদেশ: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংস্কারের ধরন ও পরিধি নির্ধারণ করবে রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হবে যে নির্বাচন কত দ্রুত হবে।
সম্প্রতি বেসরকারি গণমাধ্যম ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, সংস্কার ও নির্বাচন সম্পূর্ণই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের বিষয়, কারণ দেশের জনগণের প্রত্যক্ষ মতামত নিতে হলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে।
নির্বাচনের বিষয়ে তার বক্তব্য, ‘সংস্কার যত দ্রুত হবে, নির্বাচনও তত দ্রুত হবে। আর যদি রাজনৈতিক দলগুলো বলে যে তারা সংস্কার চায় না, তাহলে এখনই নির্বাচন দিয়ে দেবো।’
নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংস্কারের জন্য নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন তিনি। ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্বাচনের পথ তৈরি করবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো কিছুই চাপিয়ে দিচ্ছি না।’ তার ভাষ্য, তার প্রশাসন কেবল প্রক্রিয়াটি সহজ করার জন্য কাজ করছে।
নির্বাচনের রোডম্যাপ সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা সমান্তরালভাবে দুটো রাস্তায় চলছি। সমান দৃষ্টিভঙ্গি, সমান প্রচেষ্টা দুটোর পেছনেই থাকবে—একটি হলো নির্বাচন, অপরটি সংস্কার।’
তিনি বলেন, ‘দু-একদিনের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন ঘোষণা হয়ে যাবে। কমিশন তার মতো চলবে। সেটা তো আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। সেখানে যা যা দরকার সেটা হবে।’
তবে তিনি উল্লেখ করেন, সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা না দেওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন কাজ শুরু করতে পারবে না। ‘প্রতিবেদন হলেই সেটা কমিশন ব্যবহার করতে পারবে না, (রাজনৈতিক) সমঝোতা হতে হবে।’
তিনি জানান, ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন। ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক হবে। সমঝোতার চেষ্টা চলতে থাকবে, কোনটা তারা চান, কোনটা চান না। আমরা কিছুই চাপিয়ে দেবো না।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘গণমাধ্যমে সম্পাদকীয় লেখা হবে, তাদের মতামত আসবে। সুশীল সমাজের মতামত নেবো।’
তার মতে, সংস্কারের সময়সীমা নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলো কত দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে তার ওপর। কারণ রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া নির্বাচন সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ‘যদি আমাদের বলে, দরকার নেই, যেভাবে আছে সেভাবেই (নির্বাচন) করে দেন, আমরা করে দেবো। এটা প্রস্তুত থাকবে। (সংস্কার) প্রস্তুতি নিতে কতদিন লাগবে সেটা সবার বিবেচনার বিষয়। নির্বাচনের জন্য হয়তো প্রস্তুত কেউ হলোই না। সংস্কারের আগেই সবাই যদি বলে নির্বাচন দিয়ে দেন, দিয়ে দিবো। আমরা কে এটাকে বাধা দেওয়ার!’
সংস্কারের সময়সীমা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমিশনগুলোর প্রতিবেদন ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ পাওয়া যেতে পারে এবং আগামী জুলাইয়ের মধ্যে সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য সরকার যথেষ্ট সময় পাবে।
তিনি উল্লেখ করেন, এটি পুরোপুরি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করছে। ‘আমাকে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই যে কতদিন লাগবে।’
সরকার কীভাবে জনগণের ইচ্ছা জানবে প্রশ্ন করা হলে তার উত্তর, সরকার জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। ‘আমরা জনগণ পর্যন্ত যেতে পারব বলে মনে হয় না। তাহলে গণভোট লাগবে।’
সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে আলোচনা হবে, সেখানে আওয়ামী লীগ থাকবে কি না, জানতে চাইলে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অধ্যাপক বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। যদি তারা চায় যে আওয়ামী লীগ এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিক, তাহলে সেটাই হবে। আমাদের বিশেষ কোনো মতবাদ দিচ্ছি না।’
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রমাণ ও সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়াই দায়েরকৃত মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটি পুরনো আইন দিয়ে গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছে। পরে আমরা সেটা থামিয়েছি।’
সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা জানান, তিনি ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেও তার সরকার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করতে পারবে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, তাকে যখন মার্কিন কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল দেওয়া হয়, তখন উভয় দল এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছিল। তিনি বলেন, ‘কাজেই আমাকে যদি কেউ অপছন্দ করতো, তাহলে তখনই তারা বলতো।’
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি যেভাবে তুলে ধরা হচ্ছে সে প্রসঙ্গে ড. ইউনূস জানান, তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলাপকালেও বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি তাকে বলেছি এটা (সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ) সবটাই মিথ্যা কথা, প্রোপাগান্ডা। এটা দেখতে হলে ভারতীয় সাংবাদিকদের এখানে পাঠান। এটা তো উন্মুক্ত জায়গা, সাংবাদিকরা এসে দেখুক, কোথায় যেতে চায় যাক। বাধা দেবে না কেউ। তারপর ভারতীয় সাংবাদিকরা আসতে শুরু করলো, কিন্তু ন্যারেটিভ পরিবর্তন হলো না।’
ড. ইউনূস বলেন, তিনি সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করেন যে দক্ষিণ এশিয়া ও উপমহাদেশের মধ্যে আরও বেশি সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য এটি একটি দুর্দান্ত উপায়।
তিনি বলেন, ‘সবাই সার্কে রাজি। একমাত্র ভারত এটা পছন্দ করছে না বলে অগ্রসর হচ্ছে না। আমি ভারতে এনকারেজ করে যাচ্ছি।’
তবে প্রধান উপদেষ্টা জোর দেন যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক অনেক বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, মতপার্থক্য থাকতে পারে তবে সেটা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করবে না।
তার ভাষ্য, এই দুই প্রতিবেশী দেশের এত দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং অবস্থান এমন যে একজন অন্যজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছাড়া সত্যিই টিকতে পারবে না।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে জানতে চাইলে ড. ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। সেখানে চীনা প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও প্রোটোকলের কারণে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করা যায়নি।
তারপরও তিনি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। ড. ইউনূস বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে দেখা হয়নি। আমরা এক জায়গায় বসেছিলাম।’
প্রধান উপদেষ্টা জানান, তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে চীনা প্রতিনিধি দল দীর্ঘ বিবৃতি তুলে ধরেছে এবং তিনিও একটি দীর্ঘ বিবৃতি তুলে ধরেন। একসঙ্গে কীভাবে আরও কাজ করা যায় তা নিয়ে উভয়পক্ষই মতবিনিময় করে।