মাহে রমজানে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান হচ্ছে রোজা পালন করা। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী মুসলিম নর-নারীর ওপর আল্লাহ এ বিধান করেছেন। এজন্য রোজা রাখার পর সতর্ক থাকতে হয়, যেন এমন কিছু না হয়, যার দ্বারা রোজা ভেঙে যায়। কুরআন, হাদিস এবং ফেকাহের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থগুলোতে রোজা ভঙ্গের অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে দুটি কারণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়—১. ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করা এবং ২. স্ত্রী সহবাস অথবা স্বেচ্ছায় যে কোনো যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়া। মাহে রমজানে এগুলো বড় ধরনের পাপ। এর দ্বারা রোজা ভেঙে যায় এবং রোজার কাজা ও কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব হয়। সুরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—‘তোমরা সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত পানাহার করো, এরপর রাত আসার আগ পর্যন্ত সিয়াম পালন করো। মসজিদে এতেকাফ অবস্থায় নারী সম্ভোগ থেকে বিরত থাকবে। রোজা সম্পর্কে এগুলো আল্লাহর সীমারেখা, তোমরা এ সীমারেখা অতিক্রম করো না।’
এই আয়াতে কারিমায় মহান আল্লাহ বান্দাকে রোজা পালনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন—সুবহে সাদিকের আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তাই এই সময়ের মধ্যে রোজা রেখে কেউ পনাহার এবং কামাচারে লিপ্ত হতে পারবে না। তবে ভুলক্রমে কিছু খেলে ও পান করলে তাতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। সহিহ্ বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, নবি করিম (সা.) বলেন—‘ভুলক্রমে কেউ পানাহার করলে সে যেন তার রোজা পূর্ণ করে।’ তবে হ্যাঁ, কেউ ভুলে পানাহার করার পর যদি মনে করে, তার রোজা ভেঙে গেছে। এরপর কিছু খেলে ও পান করলে তার রোজা হবে না। পরবর্তীকালে এ রোজাটি কাজা করতে হবে। কেউ জবরদস্তিমূলক কিছু খাইয়ে দিলে রোজা ভেঙেযাবে। আবার রাত আছে ভেবে সুবহে সাদিকের পর আহার করলে রোজা হবে না। ইচ্ছাকৃতভাবে মুখভরে বমি করলে রোজা ভেঙে যাবে। তবে অনিচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি হলে তাতে রোজা ভঙ্গ হবে না। প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা (রাযি) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—‘যে ব্যক্তি অনিচ্ছায় বমি করল, তাকে উক্ত রোজা কাজা করতে হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় বমি করল, তাকে সেই রোজা কাজা করতে হবে।’ অনিচ্ছাকৃতভাবে অজু বা গোসলের সময় যদি পানি গলার ভেতরে চলে যায় কিংবা নাক দিয়ে খাদ্যনালিতে তা প্রবেশ করে, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে। তবে এর দ্বারা শুধু রোজার কাজা আদায় করতে হবে, কাফফারা প্রযোজ্য নয়। বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে। দাঁত থেকে বের হওয়া রক্ত এবং রক্ত মিশ্রিত থুতু গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে। তবে মুখের মধ্যকার থুতু ও শ্লেষ্মা ভেতরে গেলে রোজা ভাঙবে না। ধূমপান করলে রোজা ভেঙে যাবে। ইচ্ছাকৃতভাবে কয়েল ও আগরবাতির ধোঁয়া গলার ভেতর টেনে নিলে রোজা ভেঙে যাবে। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ধোঁয়া ও রাস্তার ধুলাবালি যদি নাক ও মুখ দিয়ে প্রবেশ করে, তাহলে রোজা ভাঙবে না। রোজার দিন স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভাঙবে না। মহিলাদের পিরিয়ড ও প্রসবোত্তর স্রাব শুরু হলে তত্ক্ষণাৎ তারা রোজা ভেঙে ফেলবেন। তবে জনসম্মুখে পানাহার করবেন না।
রোজা রেখে মুখে ওষুধ সেবন করলে রোজা ভেঙে যাবে। অনুরূপভাবে কান, নাক ও মলদার দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করানোর ফলে যদি সরাসরি তার প্রভাব পাকস্থলীতে গিয়ে পৌঁছে, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে। রোজা অবস্থায় গ্লুকোজ ও বলবর্ধক ইঞ্জেকশন ছাড়া জীবনরক্ষাকারী সবধরনের ইঞ্জেকশন, ইনসুলিন এবং যে কোনো ধরনের টিকা নেওয়া যাবে, এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। রোজা অবস্থায় শরীরের ক্ষতস্থানে মলম ও ওষুধ ব্যবহার জায়েজ আছে। তবে কান ও নাকের ভেতর তেলের ফোঁটা দেওয়ার পর যদি তা মাথার ভেতর চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে।
ছোলার সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি খাদ্য দাঁতের মধ্যে আটকে থাকার পর তা গিলে খেলে রোজা ভেঙে যাবে। ছোলার পরিমাণের চেয়ে কম হলে তাতে রোজা ভাঙবে না। সেহরি শেষ করে পান খেতে খেতে তা মুখে রেখে ঘুমিয়ে গেলে যদি সুবহে সাদিক হয়ে যায়, তাহলে রোজা হবে না।
রোজা অবস্থায় শরীরের কোনো অঙ্গ থেকে রক্ত বের হলে কিংবা প্রয়োজনবশত কাউকে রক্ত দিলে রোজা ভাঙবে না। তবে রোজা রেখে অপ্রয়োজনে ইচ্ছাকৃত রক্ত বের করা মাকরুহ। রোজা অবস্থায় চোখে ড্রোপ ব্যবহার করা যাবে। তবে নাকে নস্য ব্যবহার করা যাবে না।
রোজা রেখে সুরমা লাগানো, তেল ও আতর ব্যবহার জায়েজ আছে, গাছের কাঁচা ডালা দিয়ে মেসওয়াকও করা যাবে, এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে টুথপেস্ট ও মাজন ব্যবহার করলে তা গলার মধ্যে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে রোজা পালনরত অবস্থায় এগুলো ব্যবহার মাকরুহ বলা হয়েছে। রোজা রেখে পরনিন্দা করা নিষেধ। এর দ্বারা অনেক ইমামের মতে রোজা ভেঙে যায়। তবে হানাফি মাজহাবমতে রোজা না ভাঙলেও মাকরুহ হবে। রোজা রেখে মিথ্যা বলা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অশ্লীল কথাবর্তা বলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এর দ্বারা রোজা মাকরুহ হয়।
শরিয়তের পরিভাষায় এমন কিছু ওজর রয়েছে, যেগুলোর কারণে মহান আল্লাহ রোজার বিধান কিছুটা সিথিল করেছেন। মুসাফির ব্যক্তি রোজা ভাঙতে পারবেন। তবে ভঙ্গকৃত রোজাগুলো পরবর্তীকালে তাকে কাজা করতে হবে। এমনিভাবে গর্ভবতী মা যদি মনে করেন যে, রোজা রাখার ফলে তার গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হতে পারে, তাহলে তিনিও রোজা ছেড়ে দিতে পারবেন। তবে সুবিধাজনক সময়ে তাকে ভঙ্গকৃত রোজাগুলো কাজা করতে হবে। অনুরূপভাবে অসুস্থ ব্যক্তির রোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে তিনিও রোজা ভাঙতে পারবেন। কারো যদি এমন তৃষ্ণা পায় যে, পানি পান না করলে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে তিনিও রোজা ভাঙতে পারবেন। কাউকে সাপে দংশন করলে কিংবা হঠাত্ অসুস্থ হয়ে পড়লে সে ব্যক্তিও রোজা ভাঙতে পারবেন। মোটকথা কারো শরীর বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকলে তার জন্য রোজা ভাঙার অনুমতি রয়েছে; তবে পরবর্তীকালে ভঙ্গকৃত রোজাগুলো কাজা হিসেবে করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে রোজার নিয়মকানুন জেনে সঠিকভাবে তা পালনের তাওফিক দান করুন। আমিন!
লেখক: পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় শ্রেষ্ঠ ইমাম, খতিব, মনিপুর বাইতুল আশরাফ (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা