আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : দিল্লি কেবল মোগলদের রাজধানীই নয়, উর্দু কবিতা ও মুশায়রারও রাজধানী। সিপাহি বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে প্রহসনের বিচারে দিল্লি থেকে নির্বাসিত করেছিল সুদূর রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গুন)। তিনি তার জন্মভূমির মাটিতে কবরস্থ হতে পারবেন না, এই দু:খে লিখেছিলেন:
“কিতনা বদনসীব হ্যায় জাফর, দাফন কে লিয়ে
দো গজ জমিন ভি না মিলি কু’য়ে ইয়ার মে।”
(জাফর, তুমি কত হতভাগ্য যে, দাফনের জন্য
প্রিয় বন্ধুর (জন্মভূমি) কাছে দুই গজ মাটিও পেলে না।)
বাহাদুর শাহ জাফর ভারত ও ভারতবাসীকে ব্রিটিশের গোলামির শেকল থেকে মুক্ত করতে অশীতিপর বয়সে ১৮৫৭ সালে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নির্বাসিত হয়েও তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন, ভারতবাসী তাকে আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। মোগলদের স্মৃতিজড়িত এই দিল্লি নগরীতে এখন আত্মনির্বাসনের জীবন বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে আগত সবচেয়ে স্বেচ্ছাচারী নিপীড়ক স্বৈরশাসক শাসক শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রকে পীড়নযন্ত্রে পরিণতকারী এই শাসক জনরোষ থেকে জীবন বাঁচাতে তড়িঘড়ি পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন দিল্লিতে। সেখানে বসে কি ভাবছেন তিনি? যে ভাষাকে তিনি তিনি আশৈশব ঘৃণা করে এসেছেন পাকিস্তানের ভাষা বলে। তিনি বিরোধী দলের নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিদ্রƒপ করতে উর্দু ভাষা প্রয়োগ করেছেন। সেই উর্দু ভাষার কবিরা শেখ হাসিনার মতো শোচনীয় অবস্থায় পতিতদের সম্পর্কে কি বলেছেন, তা দেখা যাক:
“কেহ দো ইন হাসরতোঁ সে কাহি আউর যা বাসেঁ,
ইতনি জাগা কাহা হ্যায় দিল-এ-দাগদার মে।”
(আমার আকাংখাগুলোকে অন্য স্থান বেছে নিতে বলো,
এই বিক্ষত হৃদয়ে আকাংখার পুষে রাখার স্থান কোথায়!)
এমন অবস্থায় পড়লে লোকজন নিজের দোষের চেয়ে তার চারপাশের লোকজনকেই বেশি দোষারূপ করে:
“জিন্দেগি আপনি থি,
বরবাদ লোগো নে কর দি।”
(জীবনটা নিজের ছিল,
লোকজন সর্বনাশ ঘটালো।)
এমন ফান্দে পড়লে জীবনের ওপর আর কোনো মায়াও থাকে না, প্রতিটি দিনকে মনে হয়, আজকেই জীকনের শেষ দিন:
“মুঝে পরওয়া নেহি আপনে কাল কি,
ম্যায় আপনা হর দিন আখেরি সমঝ কে জিতা হুঁ।”
(কাল আমার ভাগ্যে কি ঘটবে তা নিয়ে পরোয়া করি না,
আমি প্রতিটি দিনকে আমার শেষ দিন ভেবে বেঁচে আছি।)
এ সময়ে ফেলে আসা দিনগুলোর জাঁকজমকপূর্ণ, ক্ষমতার ঐশ্বর্য স্মরণ করে তার আফসোস জাগে। কোথায় রাজ্যপাট, কোথায় শানশওকত। সাড়ে পনেরো বছরের সাধনা এবং প্রতিপক্ষকে হত্যা, গুম, আটক করে তোষামোদকারী পরিবেষ্টিত ‘আমিত্বে’র যে সাম্রাজ্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন, ছাত্রদের সংক্ষিপ্ত, কিন্তু বেপরোয়া সংগ্রামে সেই সাম্রাজ্যের প্রাচীর খান খান হয়ে যায়। তিনি নিজে পলায়নের রাস্তা বেছে নিলে চাটুকাররাও যে যার জান বাঁচাতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। জাবর কাটার সময়ে তিনি সহসা নিজেকে মর্যাদাহীনও ভাবতে পারেন। চোখ ঠেলে আসা অশ্রু তো ঠেকানো যায় না:
“ম্যায় আপনি বেক্বদরি পে বহুত রোয়া,
ইয়ার ম্যায় ইতনা সস্তা তো না থা।”
(আমি আমার মর্যাদাহানিতে অনেক কেঁদেছি,
বন্ধুরা, আমি তো কখনও এতটা সস্তা ছিলাম না।)
তার সুখের দিনের সঙ্গীরা সবাই এ বিপর্যয়ের জন্য তাকেই দোষারূপ করছে। শেখ হাসিনা কাউকে তার নিজের দু:খের কথা শোনাতে পারছেন না। তার সঙ্গীরা হয়তো আপনজনকে তাদের দু:খের কাহিনি শোনাচ্ছে। তারাও মহাবিপদের মধ্যে আছে। কিন্তু পতিত শাসকের মনে হয়, তারা ভালোই আছে, শান্তিতে ঘুমাচ্ছে:“সব সো গ্যয়ে আপনা দর্দ আপনো কো সুনা কর,
কোঈ হোতা মেরা তো মুঝে ভি নিন্দ আ জাতি।”
(সবাই আপনজনের কাছে দু:খের কথা বলে ঘুমিয়ে গেছে,
আমার আপন কেউ থাকলে আমারও ঘুম এসে যেতো।)
দুরবস্থার মধ্যে পড়ে এখন তার মনে হচ্ছে, যারা তার কৃপার প্রার্থী ছিল, তাদের রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠনের অবারিত সুযোগ দেওয়া সত্বেও তারা কেউ তার ওপর সন্তুষ্ট ছিল না। এত পাওয়ার পরও তারা সবাই আরও চেয়েছে:
“কোঈ ভি মুঝ সে খুশ নেহি,
আউর ম্যায় খুদ সে পেরেশান হুঁ।”
(কেউই তো আমার ওপর সন্তুষ্ট ছিল না,
আর আমি নিজেকে নিজেই এখন বিচলিত।)
এখন তো আর করার কিছু নেই। ৪৩ বছর আগে ছেড়ে যাওয়া পরিচিত দিল্লি নগরী এখন তার কাছে কেমন অচেনা। বিপদের আশ্রয় এই নগরীতে অচেনা মানুষ হয়ে কতদিন থাকতে হবে, কে জানে:
“আব থোড়া আজনবী হি রেহনে দো মুঝে
কঈ বার খাস সে আম হুয়া হু ম্যায়।”
(এখন আমাকে কিছুটা অচেনাই থাকতে দাও,
আগেও আমি বিশেষ থেকে সাধারণ হয়েছি।)
এখান থেকে তিনি আর কোথায় যাবেন। বিভিন্ন দেশ আগেভাগে ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা তাকে স্থান দেবে না। দিল্লিশ্বররা বরং তার অনেক আপন। জিগরি দোস্ত। কোথাও গিয়ে এমন স্বস্তি বোধ করবেন না তিনি:
“মেরা দিল নেহি লাগতা আব কাহিঁ ভি,
এ্যয়সা লাগতা জ্যয়সে আব মওত আনে ওয়ালি হো।”
(কোথাও গিয়ে এখন আর হৃদয়ে স্বস্তি বোধ হবে না,
এখন এমন মনে হয় যেন মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে।