আদিত্য শাহীন: সংগঠনের শহর নিউ ইয়র্ক। অন্য জাতিগোষ্ঠী বা ভাষাভাষীরা নিউ ইউ ইয়র্কে সংগঠনের এই প্রাচুর্য সম্পর্কে খুব বেশি জানেন কি না জানি না। তবে বাংলাদেশিরা জানেন। এই শহরে বাংলাদেশিদের মাঝে অসাধারণভাবে সংগঠনের অনুশীলন চলে। উষ্ণ তাপমাত্রার সময় জুড়ে সংগঠনের পিকনিক আর প্রীতিভোজ চলতে থাকে। অন্যান্য সময়েও সংগঠনেরর কাজ থাকে। সংগঠনের নানা কার্যক্রম, কমিটি, পাল্টা কমিটি, অভিযোগ অনুযোগ স্থানীয় বাংলা পত্রিকারগুলোর প্রধানতম খোরাক। এখানে খুব কম মানুষ আছেন যিনি কোনো সংগঠনের সঙ্গে নেই। সংগঠনের যুক্ত অনেকেই সংগঠনকে জীবনের সর্বোচ্চ স্বপ্ন, বিনোদন ও আশা আকাঙক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করেন।
সংগঠন নিয়ে এই শহরের সাধারণ অধিবাসীদের মনোভাব মিশ্র। বাংলাদেশ থেকে নিউ ইয়র্ক শহরের সংগঠনের এই বিপুল বিস্তারকে দেখা হয় নেতিবাচক হিসেবে। কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশিদের এক ইউনিয়নেরও একাধিক সমিতি রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি রয়েছে। কারো কারো বিবেচনায় এই সংগঠনই বাংলাদেশের পারিবারিক ও সামাজিক সৌন্দর্যের প্রতীক। এ এক আলাদা ধরণের যুথবদ্ধতার প্রতিনিধিত্ব করে। সংগঠনকে যারা ভালেবাসেন তারা বলেন, গ্রুপিং এরও সৌন্দর্য আছে। সংগঠন থাকলে একটু দলাদলি রেষারেষি থাকবেই। এটি সংগঠনের আলাদা ব্যঞ্জনা।
একটি সংগঠনের উত্তাপ ও উষ্ণতা কত সুগঠিত ও আবেগ সঞ্চারি হতে পারে তা দেখলাম নিউ ইয়র্কের সন্দ্বীপ সোসাইটির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। অতি সম্প্রতি এই সংগঠনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সংশ্লিষ্টরা বলেন, কোনো আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে সন্দ্বীপ সোসাইটি এই শহরের নয় শুধু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কমিউনিটি সংগঠন। যার সদস্য সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি। গত পাঁচ ছয় মাস আগে থেকে পত্র পত্রিকায় এই নির্বাচন নিয়ে খবর লক্ষ করছিলাম। মাঝে মাঝে পরিচিত দুয়েকজনের মাধ্যমে খবর পাই, সন্দ্বীপ সোসাইটির নির্বাচন নিয়ে ব্রুকলিনে উৎসবমুখর পরিবেশ। রেঁস্তোরা রেঁস্তোরায় চায়ের কাঁপে ঝড়। দুটি প্যানেলের নির্বাচন। প্রার্থীরা সবাই একে অপরের আত্মীয় স্বজন ভাই বন্ধু। দূরের কেউ নয়। দু’পক্ষই বাংলাদেশের নির্বাচনী জনসংযোগের আদলে প্রার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে যাচ্ছেন। মাথায় হাত রেখে দোয়া নিচ্ছেন। প্রত্যেক ভোটারের বাড়িতে যাওয়া নয় শুধু পৃথক দুটি প্যানেলের নির্বাচনী কার্যালয়ে রীতিমত বাসায় রান্না করা খাবার সরবরাহ হচ্ছে। একেক সন্ধ্যায় জমে উঠছে সাড়ম্বরপূর্ণ খাওয়া দাওয়া। এসব আয়োজনকে ঘিরে উতলে উঠছে উদ্দীপনা।
আমি দুই প্যানেলের একেকজন করে প্রার্থীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই আপনাদের সম্ভাবনা কেমন? দুজনের কাছেই একই রকম মন্তব্য শুনেছি। এটি এমনই এক নির্বাচন, জয় পরাজয়ের পূর্বাভাস কোনোভাবেই দেয়া সম্ভব নয়। টান টান উত্তেজনা। নিজেদের ভেতরে ভোট। এলাকার মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও দাবি পূরণের অনেক প্রশ্ন জড়িত। মানুষ এলাকার প্রতিনিধির কাছে অতীতে কেমন সম্মান, উপকার ও মনোযোগ পেয়েছে সেসব বিষয় তা বিবেচনা করবে এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে। অবাক হয়েছি, এই নির্বাচন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্নমুখি প্রচারণা। সেখানে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষদগার নেই, কারো বিরুদ্ধে কুৎসা নেই, পরস্পরকে খাটো করার প্রতিযোগিতা নেই।
জেনে নিলাম ২৯ অক্টোবর ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড এভিনিউতে ওই নির্বাচন। আমি নির্বাচনটা কাছ থেকে দেখতে চাই। এই নির্বাচনের প্রস্তুতি জনসংযোগ থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয় আমার কাছে অন্যরকম মনে হয়েছে। নির্বাচনের পুরো পরিবেশ দেখতে সংশ্লিষ্টদের অনুমতি প্রয়োজন। বিষয়টি মাথায় নিয়েই দুয়েকজনের সঙ্গ আলোচনা করতেই পেয়ে গেলাম প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ফোন নাম্বার। আগ্রহের কথা জানাতেই তিনি সম্মত হলেন। আমার জন্য পৃথক কার্ড উৎসব থাকবে বলেও জানালেন।
সেদিন দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। সকাল থেকে বেশ ঠাণ্ডা আর বৃষ্টি। জানা গেল সকাল আটটায় ভোটগ্রহণ শুরু হবে। আমি যেতে যেতে এগারোটা বেজে গেল। ব্রুকলিনের ১৭০ পাবলিক স্কুলে ভোটকেন্দ্র। কেন্দ্রের বাইরে রীতিমত জমজমাট পরিবেশ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষ আসছেন ভোট দিচ্ছেন। নির্বাচন সহায়ক কর্মীরা ব্যস্ত প্রার্থীর ভোটার নাম্বার খুঁজে দিতে। দেখলাম, সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের ভোট গ্রহণের জন্য সব রকমের আয়োজন ও বিধি ব্যবস্থাই রয়েছে সেখানে। পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি কোনো কমিউনিটি সংগঠনের নির্বাচন। আয়োজনের বিস্তৃতি শৃংখলা, মানুষের উৎসব মুখরতা দেখে মনে হয় জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন।
নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে কার্ড নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সেখানেও পর্যাপ্ত সংখ্যক পোলিং এজেন্ট, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট মানুষ। ভোট চলছে শান্তিপূর্ণ, অবাধ এ স্বতস্ফুর্ত। সবাই ভোটকেন্দ্রের পোলিং বুথে এভিএম পদ্ধতিতে ভোট দিচ্ছেন। তাদেরকে সহায়তা করার জন্য অন্য ভাষী ছেলে মেয়েরা রয়েছে। সব মিলিয়ে আয়োজনের যে উজ্জ্বলতা ও পরিপূর্ণতা তা এক কথায় অসাধারণ। যেখানে নির্বাচন কমিশনের কথার বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। কারো কোনো মতবিরোধ নেই।
সকালের এই পরিবেশ দেখে মনে হলো ভোট শেষ হওয়ার মুহূর্ত থেকে ফলাফল ঘোষণাটিও দেখা দরকার। রাত আটটা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে। ফলাফল ঘোষণা হবে তখনই। কারণ ইভিএম পদ্ধতি। ভোটে ভোটে অটো কাউন্ট হয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা সাতটায় ১৭০ পাবলিক স্কুলেও একই উৎসব মুখরতা। ভেতরে ভোটগ্রহণ চলছে। দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার ভেতর ভোট গ্রহণের হার বিস্ময়কর। সাড়ে পাঁচ হাজার ভোটের ভেতর তিন হাজার দুই’শ পঞ্চাশের ওপরে ভোট গ্রহণ হয়ে গেছে। শেষ। মুহূর্ত ভেতরে থেকেও মুগ্ধ হওয়ার মতো অনেক কিছুই চোখে পড়লো। তখনও দুয়েকজন আসছেন ভোট দিতে। ৩ হাজার ২’শ ৭৪ ভোট মনিটরে যখন প্রদর্শিত হচ্ছে, তখন শেষ হলো ভোটগ্রহণ।
প্রার্থীদের মধ্যে টান উৎকন্ঠা। কারো বিন্দুমাত্র ধারণা নেই ফলাফল কী হতে যাচ্ছে। নির্বাচন মানে গণরায়। এই রায় কোন দিকে যাবে কেউ জানে না। কারো মুখে কোনো কথা নেই । কমিউনিটি সংগঠনের নির্বাচনে এত উৎকন্ঠা ও উচ্ছ্বাস অথচ পরস্পরের প্রতি সম্মান সুরক্ষার ব্যাপারটি আমার কাছে এক উদাহরণ মনে হচ্ছে।
দুই প্যানেলের প্রার্থীরা এলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশন পাঁচ সদস্যের কমিশন নিয়ে দাঁড়ালেন। ভোটকেন্দ্রের পাশেই বেশ বড়সড় হলরুম। সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। বাইরে অপেক্ষমাণ ভোটারদের ডাকা হলো সসম্মানে। অত্যন্ত ধৈর্য্য, শৃংখলা ও নিয়মানুবর্তিতার পরিচয় দিয়ে পারস্পারিক সম্মান রেখে নির্বাচন কমিশন ফলাফল ঘোষণা করলেন। তার আগে নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বক্তব্যে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহিতা করলেন। শীর্ষ প্রার্থীরা নির্বাচন সম্পর্কে তাদের ইতিবাচক মনোভাব ও যে কোনো ফলাফলের প্রতি সমর্থন ও সম্মান রাখার ঘোষণা দিলেন।
নীচ থেকে ওপরের দিকে যখন ফলাফল ঘোষণা হচ্ছে তখন স্বতস্ফূর্ত হাততালি। নির্বাচিত প্রার্থীদের চেহারায় সরল উচ্ছ্বাস। কারো কারো অশ্রুসজল অবস্থা। ফলাফল ঘোষণা যখন শেষ হচ্ছে তখন লক্ষ করছি, মঞ্চে দাঁড়ানো প্রার্থী থেকে শুরু করে বহু ভোটার হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছেন। ফিরোজ আলমগীর পরিষদ পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভ করেছে। ওই প্যানেলের শীর্ষ প্রার্থীরা আর তাদের আত্মীয় স্বজন ভাই বন্ধুরা কাঁদছেন। মায়েরা বোনারা কাঁদছেন। আনন্দাশ্রু আগেও অল্প স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু এমন বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আনন্দের এমন কান্না এর আগে কখনো দেখিনি।
নির্বাচন ফলাফল ঘোষণার পর বাইরের পরিবেশ অন্যরকম। সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। তখন আর নির্বাচনে অবতীর্ণ দুটি প্যানেল নেই। জয়ীদের ঘিরে একাত্ম হয়ে গেছে সবাই। পরস্পর প্রার্থীরা, আত্মীয় স্বজনেরা। প্রশ্ন জাগছিলো, জয়লাভে এত আবেগ উচ্ছ্বাস কান্নার কারণ কি হতে পারে? একজন বললেন, গোটা সন্দ্বীপ একটি পরিবার। এখানে সবাইকে সবাইকে চেনে। নির্বাচনে অবতীর্ণ সবাই একে অপরের আপনজন। এ যেন পারিবারিক এক প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্রীড়া উৎসব।
মনে হলো, অস্থিরতা, অনাস্থা ও পারস্পারিক দ্বন্দ্ব সংঘাত দেখতে দেখতে এমন সুশৃংখল উচ্ছ্বাসটি অদেখা এক ব্যতিক্রম। এটি আমাদের হারিয়ে আসা দিন অথবা কাঙ্ক্ষিত দিনের মতো।