আসছে ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হবে কপ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ)-এর ২৮তম শীর্ষ সম্মেলন। বিশ্বনেতাদের সরব উপস্থিতি থাকবে জাতিসংঘের এই শীর্ষ জলবায়ু সম্মেলনে। সম্মেলনে রেকর্ড ব্রেকিং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা ও বার্ষিক কার্বন নিঃসারণ কমানোর বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে যথারীতি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে লড়াই চলছে, তার পটভুমিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবারের মতো এবারের সম্মেলনেও বেশ কিছু প্রত্যাশা থাকবে বিশ্ববাসীর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কপ-২৮ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আমরা ভালো সংবাদ শুনব বলেই আশা রাখি। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় বৈশ্বিক লড়াইয়ের প্রশ্নে কার্যকর ও জুতসই উদ্যোগের অবতারণা ঘটবে বলেও প্রত্যাশা থাকবে। চাওয়া থাকবে, জলবায়ু অর্থায়ন (ক্লাইমেট ফান্ডিং) বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্বালানি স্থানান্তরের (জীবাষ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে নবায়নযোগ্য উেসর সন্ধান) বিষয়ও গুরুত্ব পাবে সব মহলে।
ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ মিটিং তথা কপের এবারের শীর্ষ সম্মেলনে প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকবে অন্যান্য বারের চেয়ে। এর কারণ, ২৮তম কপ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বেশ বড় পরিসরে। কপ-২৮-এর আয়োজক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএইউ)। সম্মেলনে ৭০ হাজারেরও বেশি প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবে বলে এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে। ইউএইয়ের রাজধানী দুবাইয়ে সম্মেলন উপলক্ষ্যে জড়ো হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে থাকবেন বহু সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাবসায়িক ও আর্থিক নেতা, তরুণ আইনজীবী, আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। বিভিন্ন লবিস্টের পাশাপাশি সম্মেলনে অংশ নেবেন জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির প্রতিনিধিরা। বলা হচ্ছে, কপ-২৮ সম্মেলনে উপস্থিতির সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না। এই বিচারে এবারের সম্মেলন থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করাটা বাড়াবাড়ি হবে না মোটেই।
মনে থাকার কথা, গত বছর মিশরের শারম আল-শেখে অনুষ্ঠিত কপের ২৭তম শীর্ষ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশগুলোর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এটা ইতিবাচক পরিবর্তন বটে। এবারও ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে না বলেই প্রত্যাশা থাকবে। এ ধরনের পরিবর্তন আমাদের আশার পথ দেখায়। যদিও সম্মেলনে যেসব প্রতিশ্রুতির কথা শোনা যায় অংশগ্রহণকারীদের মুখে, বাস্তব ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ ঘটতে দেখা যায় না কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। তবে পরিবর্তন আসছে, এটাই-বা কম কীসে?
কপ-২৮ সম্মেলনে মার্কিন জলবায়ু দূত জন কেরির অংশগ্রহণের কথা রয়েছে। উপস্থিত থাকবেন চীনের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি জি জেনহুয়াও। বিশ্বের দুই বৃহত্তম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারীর এবারের সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করার সংবাদ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কম পাওয়া নয়।
আমরা জানি, চলতি নভেম্বরে অনুষ্ঠিত এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশনের (এপেক) শীর্ষ সম্মেলনের নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। উক্ত সম্মেলনে মিথেন গ্যাস নির্গমনসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর বিষয়ে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে এ দুই দেশ। এরই ধারাবাহিকতায় আসন্ন কপ-২৮ সম্মেলনে দুই দেশের পাঠানো প্রতিনিধিদের মুখ থেকে উক্ত বিষয়ে পুনঃপ্রতিশ্রুতির আশা তো থাকবেই, একই সঙ্গে থাকবে প্রতিশ্রুতি ত্বরান্বিত করার রূপরেখা। অবশ্য জলবায়ু সহযোগিতার জন্য নতুন করে ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ চালু করার বিষয়ে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে বলে জানা গেছে ইতিমধ্যে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হওয়ার অর্থ হলো এ ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা কাজ এগিয়ে থাকা, যা সত্যিই আনন্দের সংবাদ। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন একই কথা। তাদের ভাষ্য, জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মার্কিন-চীন উদ্যোগ আলোর পথ দেখাবে। কপ-২৮-এ এ দুই পক্ষের অংশগ্রহণ জলবায়ু চুক্তির প্রশ্নে বড় ধরনের সম্ভাবনা বয়ে আনবে নিঃসন্দেহে। তবে এ-ও মাথায় রাখতে হবে, মার্কিন-চীন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ু চুক্তির কোনো বিষয় ঝুলে যায় কি না!
জানিয়ে রাখা দরকার, দুবাইয়ে কপ-২৮ শীর্ষ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির সিইও সুলতান আহমেদ আল জাবের। আমিরাতের লক্ষ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় ধরনের নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান শক্ত করা। যদিও এ নিয়ে ইতিমধ্যে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে আবুধাবিকে। এর কারণ, জীবাশ্ম জ্বালানিকে ‘পর্যায়ক্রমে আউট’ করার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছে দেশটি, এমন আলোচনা নতুন নয়।
আমরা দেখে আসছি, প্রতিবারই কপের শীর্ষ সম্মেলন ঘিরে বিক্ষোভে নামে পরিবেশবাদীরা। সম্মেলনের সময় আয়োজক দেশে বিক্ষোভ প্রদর্শনে জড়ো হতে দেখা যায় তাদের। এই অর্থে, দুবাইয়ের কপ-২৮ সম্মেলন মঞ্চের আশপাশেও তাদের জড়ো হতে দেখা যাবে বলে ধরে নেওয়া যায়। আল জাবের অবশ্য ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, ‘বিক্ষোভকারীদের দেশে প্রবেশে কোনো ধরনের বাধা দেব না আমরা।’ যদিও জাবেরের এই কথার পরও নির্বিচার আটকের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন পরিবেশকর্মীরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারী গ্রুপ ফ্রিডম হাউজের ভাষ্যও এক। এই সংস্থার ভাষ্যানুযায়ী, নাগরিক স্বাধীনতার বিধিনিষেধ ও রাজনৈতিক অধিকারের খর্বতার কথা বিবচেনা করে বলা যায়, জলবায়ুকর্মীদের বিক্ষোভ সামলাতে তাদের বাধা (ধরপাকড়) না দিয়ে থাকতে পারবে না আমিরাত।
কপ-২৮ সম্মেলনে জলবায়ু তহবিল ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকারে পরিণত হচ্ছে, সেই সব দেশের জন্য এটা খুশির সংবাদ স্বাভাবিকভাবেই। এই সম্মেলনে মোটাদাগে চারটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্ব পেতে পারে। এক, জ্বালানি ব্যবহার স্থানান্তর। দুই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃৃত্বে ৬০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত রুখতে কাজ করা। তিন, জলবায়ু অর্থায়ন (তহবিল) বাড়ানো। চার, জলবায়ু অভিযোজন ও স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসই উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
দুঃখজনক খবর হলো, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক জরিপে উঠে এসেছে, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির শর্ত পূরণ করছে না অধিকাংশ দেশ। কার্বন নির্গমন হ্রাসের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিভিন্ন সরকার, তা পূরণে দৃশ্যমান কোনো প্রচেষ্টাই নেই দেশগুলোর। এই প্রবণতা নিতান্তই দুঃখজনক। এভাবে চলতে থাকলে জলবায়ুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করাটা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে ঠিকভাবে কাজ করছে না দেশগুলো। এ নিয়ে তাদের যেন কোনো মাথাব্যথাই নেই! এর ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাস নেট জিরোতে নামিয়ে আনার যে প্রচেষ্টা চলছে, তা অর্জন করা আদৌ সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনকারী দেশগুলোর সতর্ক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
অনেকের জানা, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রার রেকর্ড গড়েছে। ঐ মাসে বৈশ্বিক উষ্ণতার বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখেছে বিশ্ব। এভাবে চলতে থাকলে বিপদ, জলবায়ুর হাত থেকে বাঁচা মুশকিল হয়ে পড়বে।
এখন প্রশ্ন হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে বাঁচার উপায় কী? কোন পথে হাঁটলে এড়ানো যাবে এর অভিঘাত? সত্যি বলতে, প্রতিশ্রুতি পূরণের কথা ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়েই এই বিপদ ডেকে আনছে দেশগুলো। সম্মেলনগুলোতে রেজল্যুশন হয় বটে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা সঠিকভাবে মানতে চায় না খোদ চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোই। এক্ষেত্রে কপ-২১ কিংবা ২০১৫ প্যারিস চুক্তির কথা বলা যায়। গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাসের জন্য যেসব প্রতিশ্রুতির কথা শোনা গিয়েছিল দেশগুলোর মুখে, তা কি তারা পালন করেছে ঠিকঠাকভাবে?
বাস্তবতা হলো, চুক্তি হয় বটে, কিন্তু এর কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকে না। সাধারণত আইনত বাধ্যতামূলক না হওয়ার কারণেই আগেকার প্রতিটি শীর্ষ সম্মেলনে স্বাক্ষর হওয়া চুক্তি মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আসন্ন কপ-২৮ সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কার্যকর কোনো চুক্তির নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমনকে ‘শূন্যে’ নামিয়ে আনার প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে পারে। এক্ষেত্রে কতটা সফল হয় তারা, তা দেখার বিষয়। যদিও বেশির ভাগ বিশ্লেষকের অভিমত, কপ-২৮ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের বিষয়ে হয়তোবা আগের মতো করেই কেবল প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি শোনা যাবে বিশ্বনেতাদের মুখ থেকে!
সূত্র: কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস
লেখক :জলবায়ু বিশেষজ্ঞ
অনুবাদ :সুমৃত্ খান সুজন