আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরীকদের ৩২টি আসন ছাড় দিয়ে ভোটের মাঠে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ২৯৮টি আসনে দলটি প্রার্থী মনোনীত করলেও বর্তমানে ২৬৯জন নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এর মধ্যে ১৪ দলীয় জোটের ৬জন প্রার্থী নৌকায় নির্বাচন করবেন। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি-জাপাকে ২৬টি আসন ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ২৫টি আসনে জাপার প্রার্থীদের কারণে নৌকার মনোনীত প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেছে আওয়ামী লীগ। জাপার এই ২৬জন প্রার্থী দলটির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন।
একইসঙ্গে শরিক ১৪ দলের জন্য ছয়টি আসনে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আবেদন করে দলটি। আজ সোমবার বৈধ প্রার্থীদের মাঝে প্রতীক বরাদ্দ করা হচ্ছে। প্রতীক বরাদ্দের পর আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হচ্ছে। আজ থেকে ভোট বিরোধী কোন সভা-সমাবেশ করতে পারবেন না কোন রাজনৈতিক দল। এদিকে, নির্বাচন কমিশনের সার্বিক প্রস্তুতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্নে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি।
১৭ ডিসেম্বর সারাদেশে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিলো। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর বর্তমানে ভোটে রয়েছে ১ হাজার ৮৯৬জন বৈধ প্রার্থী। গতকাল রাতে নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ৩০০ সংসদীয় আসন থেকে ৩৪৭জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। স্থগিত আছে ৫টি। বর্তমানে ২৭টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে প্রচারণা চালানোর পরামর্শ দেন ইসি সচিব।
আসন্ন ভোট নিয়ে রাজনৈতিক বিভক্তির মধ্যেই গত ১৫ নভেম্বর তপসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। গত ৩০ নভেম্বর ছিলো মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময়। নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে ২ হাজার ৭১৬জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। গত ১লা ডিসেম্বর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর পর্যন্ত যাচাই-বাছাইয়ে ৭৩১জনের প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। ১ হাজার ৯৮৫টি মনোনয়নপত্র বৈধ বলে ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসাররা। নির্বাচন কমিশনের আপিল শুনাতিতে ২৮০জন প্রার্থিতা ফিরে পান। বৈধ ৫জন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। বৈধ প্রার্থী হিসাবে মাঠে ছিলেন ২ হাজার ২৬০জন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসনে দলীয় প্রার্থিতা ঘোষণা করে। নির্বাচন কমিশনের আপিল শুনানিতে এসে আওয়ামী লীগের ৫জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ মনোনীত বরিশাল-৪ আসনে ড. শাম্মী আহমেদ, ফরিদপুর-৩ আসনে শামীম হক, যশোর-৪ আসনে এনামুল হক বাবুল, ময়মনসিংহ-৯ আসনে আব্দুস সালাম এবং কক্সবাজার-১ আসনের সালাহউদ্দীন আহমদের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। আওয়ামী লীগ যে দু’টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেনি তার মধ্যে একটি জাপা ও আরেকটি জাসদকে দেয়া হয়েছে।
৩৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই, ২৬৯ আসনে নৌকা : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক মিত্র জাপাকে ২৬টি এবং ১৪ দলের শরিকদের ছয়টি আসন ছেড়ে দিয়ে ২৬৩ আসনে ভোট করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল রবিবার নির্বাচন ভবনে দলটির দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া এক ব্রিফিংয়ে এই সিদ্ধান্ত জানান। গতকাল ছিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। যেসব আসন আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়েছে, সেসব আসনে নৌকার প্রার্থীদের প্রত্যাহারের কথা নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। ইসিতে পাঠানো চিঠিতে জাপার প্রার্থীদের ছাড় দিতে আওয়ামী লীগের ২৫ জনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর বাইরে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনটি জাপার সেলিম ওসমানের জন্য আগেই খালি রেখেছিল আওয়ামী লীগ। সেখানে কোনো প্রার্থীকে আগে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। সব মিলিয়ে জাপা ছাড় পেয়েছে ২৬ আসনে। অন্যদিকে, আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনার মধ্যে ১৪ দলের শরিকদের সাতটি আসন ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিল আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া চিঠিতে ছয়টি আসনে শরিকদের নৌকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেই সাতজনের মধ্যে সাতক্ষীরা-১ আসনের বর্তমান এমপি, ওয়ার্কার্স পার্টির মুস্তফা লুত্ফুল্লাহর নামও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ তাকে আর ছাড় দেয়নি। জাতীয় পার্টি-জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে দেওয়া হয়েছে তার পিরোজপুর-২ আসন। তিনি এ আসনে গতবার বাইসাইলে প্রতীকে নির্বাচন করলেও এবার নৌকায় ভোট করবেন। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মত কুষ্টিয়া-২ আসনেও আগে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া চিঠিতে সেখানে বর্তমান এমপি জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকেই নৌকা দেওয়া হয়েছে। ইনু ছাড়া জাসদের আরো দুইজন আওয়ামী লীগের ছাড় পেয়েছেন। তাদের মধ্যে রেজাউল করিম তানসেন বগুড়া-৪, মোশাররফ হোসেন লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে নৌকা নিয়ে ভোট করবেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন গত তিনবার ঢাকা-৮ আসন থেকে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন। এবার তাকে আওয়ামী লীগ ছাড় দিয়েছে বরিশাল-২ আসনে। তবে ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা আগের মতই রাজশাহী-২ আসনে নৌকা নিয়ে ভোট করবেন। শরিকদের জায়গা দিতে গিয়ে পিরোজপুর-২ আসনে কানাই লাল বিশ্বাস, বগুড়া-৪ আসনে মো. হেলালউদ্দিন কবিরাজ, রাজশাহী-২ আসনে মোহাম্মদ আলী, বরিশাল-২ আসনে তালুকদার মো. ইউনুস, লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে ফরিদুন্নাহার লাইলীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারণা শুরু আজ :জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে আজ। এদিন সকল দল, জোট ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করবেন নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রিটার্নিং কর্মকর্তারা। আর প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে প্রচারে নেমে পড়বেন সকল প্রার্থীরা। প্রচারণার জন্য প্রার্থীরা সময় পাবেন ১৮দিন। এর আগে দল ও জোটের হিসাবনিকাশ চূড়ান্ত হয়। গতকাল ছিলো মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ও জোটের মনোনয়ন প্রক্রিয়া। এদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টিসহ বিভিন্ন দলের অনেক প্রার্থী তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছে। এদিকে প্রচারে আচরণবিধি ভঙ্গ করলে শাস্তি ও জরিমানার মুখোমুখি হবেন প্রতিদ্বন্দ্বীরা। ভোট বিরোধী কোন ধরণের প্রচার-প্রচারণা, সভা বা সমাবেশ করতে পারবে না বলে ইতিমধ্যে সরকার থেকে জানানো হয়েছে।
প্রচারণায় যেগুলো করা যাবে না: সংসদীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮ ও এর সংশোধনী (২০১৩) অনুযায়ী, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃত পোস্টার ও ব্যানার সাদাকালো হতে হবে; পোস্টারের সাইজ অনধিক ষাট বাই পঁয়তাল্লিশ সেন্টিমিটার এবং ব্যানার অনধিক তিন বাই এক মিটার হতে হবে; পোস্টার বা ব্যানারে প্রার্থীর নিজের প্রতীক ও ছবি ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির ছবি বা প্রতীক প্রকাশ করা যাবে না। তবে প্রার্থী নিবন্ধিত কোন রাজনৈতিক দলের মনোনীত হলে দলীয় প্রধানের ছবি ব্যবহার করতে পারবেন। তবে প্রচারণা শুরুর আগেই আচরণবিধি ভেঙ্গেছে শতাধিক প্রার্থী। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি। গতকাল পর্যন্ত ইসির হিসাব বলছে-খুলনা, ঢাকা ও বরিশালসহ দশ বিভাগে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির পক্ষ থেকে ইসিতে অভিযোগ পাঠানো হয়েছে ৩৩টি। এসব প্রার্থীর মধ্যে ২২ জনকে সতর্ক করা হয়েছে। আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ৭ জনের বিরুদ্ধে এবং কমিশনের করণীয় কিছু নেই মর্মে দায়মুক্তি দিয়েছে ৪ জনকে।
ভোটে সেনা মোতায়েনে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অনুরোধে সেনা মোতায়েনে সম্মতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। গতকাল রবিবার বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে এ তথ্য জানান ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম। তিনি বলেন, পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী বেলা ১১টায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গভবনে সাক্ষাত্ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সংবিধানের ২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কমিশন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রাষ্ট্রপতির কাছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারের আওতায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় সামরিক বাহিনী নিযুক্ত করার জন্য অনুরোধ করেছেন। রাষ্ট্রপতি বিষয়টি শুনেছেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আলাপ করে অতি শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। তিনি নীতিগতভাবে সামরিক বাহিনী দিতে সম্মত হয়েছেন। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনের সার্বিক প্রস্তুতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্নে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন এ তথ্য জানান। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিবরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।