বিএনপি’র সদ্য সাবেক খাদেম অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম জীবনে অন্তত একটি বার জাতীয় সংসদে সদস্য হওয়ার আশায় নিজেকে রাজনীতির বিক্রয়যোগ্য ‘ঘোড়া’য় পরিণত করলে তাকে তেমন দোষারূপ করা যাবে না। তিনি যেহেতু নবীজির বংশের উত্তরাধিকারী একজন খাঁটি ‘সৈয়দ’, অতএব, কোনো ঐশী প্রত্যাদেশ অর্থ্যাৎ ‘ইলহাম’ বা ‘অন্তর্জ্ঞান’ লাভ করা ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেননি।
যদিও সামরিক বাহিনীর লোকজনের বিদ্যাবুদ্ধি সম্পর্কে আমার ধারণা খুব ভালো নয়, তবুও তিনি ‘সৈয়দ’ বলে কথা। তার কণিষ্ঠ ভ্রাতা মরহুম সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগেই আমার এক বছরের জুনিয়র ছিলেন এবং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু অল্প বয়সেই লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক প্রচুর পড়াশোনা করতেন। সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম যখন ব্রিগেডিয়ার তখন সৈয়দ ইসহাকের টানাটানিতে দু’একবার তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতেও গেছি। টেলিভিশন টকশো’তে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল রাজনীতির কথাবার্তায় এখন যেমন চৌকশ মনে হয়, উর্দি পরিহিতি ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে আলোচনায় কখনো তা মনে হয়নি। দর্শনীয় গোঁফে তাকে বিশাল বীরপুরুষ মনে হলেও তার বন্ধু মরহুম সাংবাদিক জাহিদুজ্জামান ফারুকের মুখে তার ভীরুতার কাহিনি আমি এখনো মনে রেখেছি।
তবে রাজনীতির জগৎ ভিন্ন। এই জগতে মোগল সম্রাটের ‘নবরত্ন’ সভায় আবুল ফজলের যেমন প্রয়োজন, তেমনি মোল্লা দোপেঁয়াজা ও বীরবলদেরও প্রয়োজন হয়। এখনো ভিন্ন আদলে নবরত্ন সভা আধুনিক রাজনৈতিক কাঠামোতে বিদ্যমান এবং এ ধরনের সভার সদস্য সংগ্রহ করতে কৌটিল্য বা মেকিয়াভেলি’র কৌশল অবলম্বন করতে হয়। সেশন জটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স-মাষ্টার্স মিলিয়ে চার বছরের কোর্স শেষ করতে আমার ব্যাচের লেগেছিল পাক্কা সাত বছর। পড়াশোনার এই প্রলম্বিত সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণে সিলেবাসে আবদ্ধ বিদ্যার বাইরে অনেক প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল।
পাঠ্যবিষয় হিসেবে রাজনীতির পাঠ নিতে গিয়ে বেশকিছু মজার পরিভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটে, যার একটি ‘হর্স ট্রেডিং’। রাজনীতির এই ‘হর্স ট্রেডিং’ ঘোড়ার বাণিজ্য নয়। কাক্সিক্ষত ফলাফল লাভের জন্য সমর্থন বৃদ্ধি করতে প্রতিপক্ষ দল বা দলসমূহে থেকে রাজনীতিবিদদের ভাগিয়ে নেওয়ার নাম ‘হর্স ট্রেডিং’। এটাও এক ধরনের কেনাবেচাই, কোনো না কোনো কিছুর বিনিময়ে সমঝোতায় উপনীত হওয়া। এই কেনাবেচা বা সমঝোতার প্রথম ‘ঘোড়া’ অবসরপ্রাপ্ত মে: জে: সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম।
পৃথিবীর বহু স্থানে প্রাচীন কাল থেকে আচরিত এই রাজনৈতিক কৌশল আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও বহাল তবিয়তে স্থান করে নিয়েছে এবং প্রায় সকল দেশে রাজনৈতিক ‘ঘোড়া’র কেনাবেচাকেও ‘হালাল’ গণতান্ত্রিক কৌশল হিসেবে গন্য করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অত্যাবশ্যকীয় অংশে পরিণত হয়েছে ‘হর্স-ট্রেডিং’। রাজনীতি যেখানে দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে, সে অবস্থায় সরকার হোক, বিরোধী দল হোক, প্রত্যেকের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে, বিশেষত সরকারি দলকে ঝামেলাহীনভাবে ক্ষমতায় থাকতে এবং বিনা বাধায় আইন পাস করানোর জন্য অন্য দল থেকে ‘ঘোড়া কেনা জরুরী হয়ে পড়ে। অবশ্য এই কেনাবেচার রাজনীতি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কারণ ‘হর্স-ট্রেডিং’ রাজনৈতিক পদ্ধতির মাঝে অনৈতিকতার বীজ বপন করে। লেনদেন নির্ভর রাজনীতি যে দুর্নীতিমূলক আচরণকে উৎসাহিত করবে, এটাই স্বাভাবিক।
এখনো স্পষ্ট নয় যে, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম স্বপ্রনোদিত ‘ঘোড়া’ অথবা বিক্রয় হয়ে যাওয়া ‘ঘোড়া’! তবে এটা স্পষ্ট, তিনি যে আদর্শের কথা টকশো বা বিভিন্ন সমাবেশে বলতেন, সংবাদপত্রের মতামত কলামে লিখতেন, তা থেকে তিনি বহু দূরে সরে গেছে। তার উচ্চারিত কথাগুলো এখন তাকে এভাবে পরিহাস করবে: “ওহে মেজর জেনারেল, রাজনীতির খেলায় তুমি নিজেকে যথার্থই একজন ‘মাইনর’ বলে প্রমাণ করলে!”
লেখক: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু