Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeমতামতবিশুদ্ধ গণতন্ত্রের সন্ধানে

বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের সন্ধানে

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’ গত সেপ্টেম্বরে তাদের ‘ওপেন সোসাইটি ব্যারোমিটার : ক্যান ডেমোক্রেসি ডেলিভার?’ শীর্ষক জরিপ প্রকাশ করেছে। বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক শাসন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশসহ ৩০টি দেশের ৩৬ হাজার ৩৪৪ জনের অংশগ্রহণে উপর্যুক্ত জরিপটি করা হয়েছে। প্রতিটি দেশে গড়ে ১ হাজার ব্যক্তি জরিপে অংশ নেন। জরিপ প্রতিবেদনের মুখবন্ধে ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট মার্ক ম্যালোচ ব্রাউন বলেছেন, ‘The reports of democracy’s demise are greatly exaggerated. In fact, it has a strong pulse. And the gravest threat it faces is not the rival appeal of authoritarianism but rather the question of whether democratic leaders can deliver for their populations’, যার অর্থ দাঁড়ায়, গণতন্ত্রের ক্ষয় নিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা অতিরঞ্জিত। আসলে গণতন্ত্রের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। গণতন্ত্র বড় যে হুমকিতে রয়েছে, তা কর্তৃত্ববাদের কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক নেতারা জনগণকে কতটা দিতে পারছেন, সেটিই বড় বিষয়। জরিপটির ফাইন্ডিংস, বিশেষ করে এতে বাংলাদেশের অবস্থান পর্যালোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

জরিপটি করা হয়েছে আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, চীন, কলম্বিয়া, মিসর, ইথিওপিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ঘানা, ভারত, ইতালি, জাপান, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, রাশিয়া, সৌদি আরব, সেনেগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, ইউক্রেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ওপর। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা প্রাপ্তবয়স্ক। চলতি বছরের ১৮ মে থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, সমতা, ন্যায়বিচার, জনগণের চাওয়া, অর্থনীতি, ক্ষমতা ও রাজনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়।

এখন জরিপের প্রধান ফাইন্ডিংস নিয়ে আলোচনা করা যাক।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার (democracy and human rights): জরিপে উঠে এসেছে যে, মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাস করতে চান। এ সূচকে শীর্ষে রয়েছেন ইথিওপিয়া। দেশটির ৯৬ শতাংশ উত্তরদাতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬২ শতাংশ) উত্তরদাতা অন্য যে কোনো শাসনব্যবস্থার চেয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে বেশি পছন্দ করেন। তবে যুবকদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ২০ শতাংশ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন, কর্তৃত্ববাদী দেশগুলো ‘নাগরিকের চাহিদা’ পূরণে বেশি সক্ষম। জরিপে অংশ নেওয়া ৭১ শতাংশ মানুষ মনে করেন, মানবাধিকার হলো মূল্যবোধের প্রতিফলন।

ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার (equity and justice): জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, তাদের রাজনৈতিক নেতারা জাতীয় পর্যায়ে এসব বিষয়ে কোনো সুফল নিয়ে আসতে সক্ষম নন। জরিপ পরিচালিত হয়েছে এমন ২১টি দেশের অধিকাংশ উত্তরদাতা তাদের দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা মনে করেন, ঋণঝুঁকি ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ধনী দেশগুলোর আরও কিছু করা উচিত। উত্তরদাতাদের ৮৪ শতাংশ মনে করেন, ঋণ প্রদানকারী দেশগুলোর উচিত ঋণের ভারে জর্জরিত দেশগুলোকে ঋণ মওকুফ, হ্রাস বা পুনঃতফশিলীকরণের মাধ্যমে সহায়তা করা। ৭৫ শতাংশের মতে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর উচিত তাদের বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা এবং ৭১ শতাংশ বিশ্বাস করেন, স্বল্প আয়ের দেশগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে দিতে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর এগিয়ে আসা উচিত।

জনগণের অগ্রাধিকার (people’s priorities): জলবায়ুর পরিবর্তনকে একটি বড় ধরনের উদ্বেগ হিসাবে দেখা হচ্ছে এবং ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, জলবায়ুর পরিবর্তন আগামী বছর তাদের জীবনে কষ্ট বয়ে আনবে। দারিদ্র্য ও বৈষম্যের সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্নীতিকে জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিকদের ওপর বিশ্বাসের মাত্রা খুব কম।

ক্ষমতা ও রাজনীতি (power and politics): উচ্চ আয়ের দেশগুলোর অধিকাংশ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন, তাদের সরকারগুলোর উচিত স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া, তবে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে অধিকতর ক্ষমতা প্রদানে আগ্রহী নন। একটি প্রশ্নের উত্তরে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে চীন সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশে পরিণত হবে।

এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে এদেশের ৯১ শতাংশ উত্তরদাতা গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে মত দিয়েছেন। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। শীর্ষে রয়েছে ইথিওপিয়া। সেদেশের ৯৬ শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয়, তৃতীয় , চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে তুরস্ক (৯৬), চীন (৯৫), ভারত (৯৩), মিসর (৯৩), আর্জেন্টিনা (৯৩), নাইজেরিয়া (৯২) ও ইতালি (৯১)। অর্থাৎ এসব দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বসবাসে আগ্রহ প্রকাশে তালিকার আট শীর্ষ অবস্থানে রয়েছেন।

মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বিশ্বের কল্যাণের জন্য মানবাধিকার একটি বড় শক্তি। এ প্রশ্নে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে নাইজেরিয়া (৮৬) ও কেনিয়া (৮৪)। কোন ধরনের মানবাধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এ প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের ৩৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার, ২৮ শতাংশ মনে করেন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার, ১৭ শতাংশ মনে করেন পরিবেশগত অধিকার এবং ১৩ শতাংশ মনে করেন ডিজিটাল অধিকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান অনন্য এ কারণে যে, দেশটির বেশিসংখ্যক উত্তরদাতা অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের চেয়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা আগামী বছর দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সহিংসতার আশঙ্কা করেছেন। হারটি সবচেয়ে বেশি কেনিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায়-৭৯ শতাংশ।

অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে কি না-এমন প্রশ্নের সঙ্গে বাংলাদেশের ৮১ শতাংশ উত্তরদাতা একমত পোষণ করেছেন। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। শীর্ষে রয়েছে ইথিওপিয়া (৮৪)।

জরিপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। শীর্ষে রয়েছে মিসর (৯০) এবং দ্বিতীয় অবস্থানে ইথিওপিয়া (৮৯)।

উপরের বর্ণনা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৯১ শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে। এদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটা তলানিতে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি) প্রকাশিত ২০২৪ অর্থবছরের সূচকের ‘ন্যায়সংগত শাসন’ (ruling justly) ক্যাটাগরির ছয়টি সূচক রাজনৈতিক অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কার্যকারিতা, আইনের শাসন, তথ্যপ্রাপ্তির স্বাধীনতা-সবকটিতেই বিপজ্জনক অবস্থানে (রেড জোনে) রয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ‘গণতন্ত্র সূচক ২০২০’-এ ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৬তম। ২০২১ সালে সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম) প্রকাশিত ‘অটোক্রাটাইজেশন টার্নস ভাইরাল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উদার গণতান্ত্রিক সূচকে ১৭৯টি দেশের মধ্যে ০.১ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫৪তম। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজের ‘বিশ্বে ২০২৩ সালে স্বাধীনতা : গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের ৫০ বছর’ শীর্ষক প্রতিবেদনে রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতায় বাংলাদেশ ‘আংশিক স্বাধীন’ দেশগুলোর সারিতে রয়েছে। ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন পরিচালিত জরিপে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের বেশিসংখ্যক উত্তরদাতা অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের চেয়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বসবাসে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নপূরণ হবে কি?

আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক সচিব, কলাম লেখক

আবদুল লতিফ মন্ডল
আবদুল লতিফ মন্ডল
সাবেক সচিব, কলাম লেখক
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments