আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু: আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তিনি সত্যের ধার ধারেন না, নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলেন। কিন্তু সত্য হলো, হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের পূর্বসূরিদের অনেকেই অবিশ্বাস্য ও ভয়াবহ ধরনের মিথ্যাচার করেছেন। এর ওপর ২০২১ সালের ৮ মার্চ বিবিসি একটি রিপোর্ট প্রচার করেছিল। যারা এটি শোনেননি বা আগে পড়েননি, তাদের জন্য রিপোর্টটি তুলে ধরছি:
ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হোসেন ১৯৯০ সালের আগস্টে যখন কুয়েত দখল করেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (বুশ সিনিয়র) হুমকি দিয়েছিলেন, “আর সহ্য করা হবেনা“ কিন্তু আমেরিকা যখন উপসাগরে সৈন্য সমাবেশ করে তখন যুদ্ধে আমেরিকানদের তেমন সায় ছিলনা। কিন্তু প্রেসিডেন্টের মিথ্যাচারে জনমত ইরাকের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধে জড়িত হওয়ার পক্ষে ঘুরে যায়।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ নিয়ে লেখা গ্রন্থে জন ম্যাকআর্থার লিখেছেন, সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে সমর্থন তৈরিতে বুশের মনগড়া গল্প কাজে লেগেছিল। ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে সিনেটে বুশের যুদ্ধ শুরুর প্রস্তাব খুব অল্প ব্যবধানের ভোটে পাশ হয়। এর কয়েকদিন পরই শুরু হয় ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’। আমেরিকান বোমা পড়ে হাসপাতালে, ইনকিউবেটর থেকে সদ্যজাত শিশুকে সরিয়ে নেয়া হাসপাতাল ভবনের শীতল বেসমেন্টে। বোমা হামলার প্রথম রাতেই বাগদাদের হাসপাতালে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বেসমেন্টে ৪০ সদ্যজাত শিশু প্রাণ হারায়।
ট্রাম্পের শাসনামলে তার বক্তব্য বিবৃতির ডাটাবেজ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। তাদের দাবি, ট্রাম্প ৩০ হাজারের বেশি এমন সব বক্তব্য দিয়েছেন যা অসত্য, বিভ্রান্তিকর। এমনকি তার গলফ খেলা বা তার নিজের সম্পত্তি নিয়ে মন্তব্যও যাচাই করেছে পত্রিকাটি।
নির্বাচন প্রক্রিয়াই ‘দানব‘ সৃষ্টি করছে
আমেরিকার রাজনীতিতে মিথ্যাচার নিয়ে লেখা এক বইতে রাজনীতির অধ্যাপক বেঞ্জামিন গিনসবার্গ বলেছেন, প্রেসিডেন্টদের অনেক মিথ্যাচারের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। তিনি বুশ সিনিয়রের পুত্র প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের অনেক মিথ্যা বিবৃতির উল্লেখ করেছেন যেগুলো দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধের আগে তার বক্তব্য। যেমন, ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের হাতে বিপজ্জনক মারণাস্ত্র থাকা নিয়ে গোয়েন্দাদের সন্দেহ ইচ্ছা করে চেপে রাখা, সাদ্দাম হোসেনের কাছে এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র থাকার সম্ভাবনার কথা বার বার বলা এবং সাদ্দামকে আল-কায়দার মিত্র বলে চিহ্নিত করা।
প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়রঅধ্যাপক গিনসবার্গ বলেছেন, প্রেসিডেন্টদের অনেক মিথ্যা ভাষণের পরিণতিতে যুদ্ধ হয়েছে। সেদিক দিয়ে ট্রাম্পের চেয়ে তার পূর্বসূরিদের দায় অনেক বেশি। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির এই শিক্ষক বলেন, “সমস্যা হচ্ছে যে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়াতেই গলদ রয়েছে, যার ফলে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনেক দানব সৃষ্টি হয়েছে। প্রার্থী হতে বছরের পর বছর ধরে প্রচারণা চালাতে হয়। ফলে, সবচেয়ে উদ্ধত, উচ্চাভিলাষী, আত্মপ্রেমিক এবং দাম্ভিক ব্যক্তিরাই এই প্রক্রিয়ার অংশ হন।” আমেরিকান জনগণ একসময় তাদেও জেনারেলকে শিশুর মত সরলভাবে বিশ্বাস করতো। মানুষের কাছে তখন প্রেসিডেন্টের অবস্থান ছিল অনেকটা ঈশ্বরের মত।
কখন তা বদলে গেল? অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের সময় থেকে মিথ্যাচারের সূচনা। কিন্তু তিনিই যে প্রথম মিথ্যাচারী প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সেটাও ঠিক নয়।
জনসনের মিথ্যাচার
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাই রবার্ট কেনেডি প্রেসিডেন্ট জনসন সম্পর্কে বলেছিলেন, “তিনি সবকিছু নিয়ে সর্বক্ষণ মিথ্যা বলেন। প্রয়োজন ছাড়াই তিনি মিথ্যা বলেন।” ভিয়েতনামের যুদ্ধের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে জনসন ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে টনকিন উপসাগরে একটি ভিয়েতকংদের নৌ হামলার কথা বলেছিলেন, অথচ সে হামলা আদৌ হয়নি। অথচ প্রেসিডেন্টের সেই বিবৃতির কারণে বিরোধের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। এছাড়া লিন্ডন বি জনসন নির্বাচনের আগে ওহাইওতে এক সভায় ভোটারদের বলেছিলেন, তিনি ১০ হাজার মাইল দূরে এশিয়ার একটি দেশে আমেরিকান সৈন্য পাঠাবেন না। কিন্তু জয়ী হওয়ার পরপরই চুপিসারে তিনি সৈন্য পাঠিয়েছিলেন ভিয়েতনামে, যে সংখ্যা শেষ পর্যন্ত পাঁচ লাখের বেশিতে পৌঁছেছিল। পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে নিয়ে প্রেসিডেন্ট জনসন এত বিভ্রান্তিমুলক কথা বলতেন যে, আমেরিকান মিডিয়া তখন খোলামেলা বলতো যে, এই প্রশাসনের কথার ওপর আস্থা রাখা যায়না।
জনসনের উত্তরসূরি রিচার্ড নিক্সন ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি “সম্মানজনক“ অবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে লড়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে কম্বোডিয়ায় কার্পেট বোমা ফেলে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছিলেন। এরপর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর আড়ি পাতার জেরে – যেটি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত ঘটনায় ক্ষমতা হারান নিক্সন।
স্কুলের বইতে প্রেসিডেন্টদের সততা নিয়ে লেখা গল্প পড়িয়ে আমেরিকায় বাচ্চাদের সততা এবং মূল্যবোধ শেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে সেই সততার কোনো অস্তিত্ব কখনই ছিলনা। প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে নিয়ে বিখ্যাত এক গল্প রয়েছে যে, বাগানের চেরি গাছ কুড়াল দিয়ে কেটে ফেলার পর তিনি তার বাবার কাছে দোষ স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘আমি মিথ্যা বলতে পারিনা বাবা।’ কিন্তু আসলে প্রেসিডেন্টের জীবনী রচনাকারী স্বয়ং এই গল্পটি সৃষ্টি করেছিলেন। অর্থ্যাৎ আমেরিকান জাতির পিতাও শতভাগ সাধু ছিলেন না। যেমন ১৮৮৮ সালে তিনি নতুন করে ইতিহাস তৈরির চেষ্টা করেন তখন দাবি করেন যে সাত বছর আগেই তিনি ইয়র্কটাউনে ব্রিটিশদের পরাজিত করার মূল পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে ভার্জিনিয়ায় সেই গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরানো যুদ্ধের প্রধান হোতা ছিল তার ফরাসী মিত্ররা।
আকাশকুসুম কল্পনা
হোয়াইট হাউজের বাসিন্দাদের কিছু কিছু মিথ্যাচার একবারে আকাশকুসুম কল্পনার মত। যেমন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন সফরকারী ইউরোপীয় একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানীকে বলেছিলেন আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে জনমানবশূন্য এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে এখনও পশামাবৃত ম্যামথ (হাতির মত দেখতে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী) চরে বেড়ায়।
রোনাল্ড রিগান
১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান বলেন যে ইউরোপে আমেরিকান বাহিনীর সিগনাল কোরের ফটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করার সময় তিনি নাৎসি বন্দী শিবিরে নির্যাতনের ছবি তুলেছেন। হোয়াইট হাউজে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজাক শামিরের সাথে আলাপের সময় রিগান এই গল্প করেন। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আমেরিকার বাইরেই যাননি।
রাষ্ট্রের মিথ্যাচার নিয়ে অধ্যাপক এরিক অলটারম্যান তার বইয়ে বলেছেন, আমেরিকা রাষ্ট্র সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রেসিডেন্টদের মিথ্যাচার মানুষ সহ্য করেছে, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প অতীতের সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছিলেন।
মিথ্যাচার নিয়ে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের নির্লজ্জতাও ছিল অবিশ্বাস্য। ১৯৯৮ সালে জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজের ইন্টার্ন মনিকা লিউনিস্কির সাথে তার যৌন সম্পর্কের অভিযোগ জোর গলায় অস্বীকার করেছিলেন তিনি। পরে তদন্তের তার মিথ্যাচার ফাঁস হয়ে যায়। অবৈধ যৌন সম্পর্ক ঢাকতে মিথ্যা বলেছিলেন বিল ক্লিনটন। কিন্তু জাতিকে ধোঁকা দেওয়া নিয়ে লজ্জা পাওয়ার বদলে তার কোনো শাস্তি না হওয়ায় ক্লিনটন স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন বলে তার জীবনীমুলক গ্রন্থ ‘দি সারভাইভর’ এ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালের আগস্টে এ নিয়ে টিভিতে এক সাক্ষাৎকারের আগে তিনি তার এক বন্ধুকে বলেছেন, “মিথ্যা আমাকে বড় বাঁচা বাঁচিয়েছে।”
হোয়াইট হাউজের যেখানে রাষ্ট্রীয় ভোজসভা আয়োজিত হয়, সেখানে পাথরের ফায়ারপ্লেসের ওপরে খোদাই করা দুটি বাক্য রয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যটি হচ্ছে: “May None But Honest And Wise Men Ever Rule Under This Roof“ (সৎ ও জ্ঞানীরা ছাড়া আর কেউ যাতে কখনো এই ছাদের নিচে শাসন না করেন।)