জয় বাংলাদেশ : কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে গভীর রাতে ঘর থেকে তুলে নিয়ে দুজন রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে রোববার দিবাগত রাত দুইটার দিকে উখিয়ার জামতলী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১৫) একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আরেক দিন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে গতকাল দিবাগত রাত চারটার দিকে উখিয়ার কুতুপালং (ক্যাম্প-৪ বর্ধিত) আশ্রয়শিবিরে। দুটি হত্যাকাণ্ডই ঘটিয়েছে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসীরা।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন জামতলী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১৫) এ-ব্লকের বাসিন্দা রোহিঙ্গা নেতা নুর বশর (৫৪) এবং কুতুপালং (ক্যাম্প-৪ বর্ধিত) আশ্রয়শিবিরের সি-১ ব্লকের বাসিন্দা কবির আহমদ (২৭)।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামতলী আশ্রয়শিবিরের একজন রোহিঙ্গা নেতা জানান, নিহত নুর বশর কয়েক মাস আগে আরসা ছেড়ে মিয়ানমারের আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সঙ্গে যুক্ত হন। তাতে ক্ষিপ্ত হয় আরসা সন্ত্রাসীরা। ঘর থেকে তুলে নিয়ে এই রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যার ঘটনায় আশ্রয়শিবিরে সাধারণ রোহিঙ্গার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ঘটনাটি নিশ্চিত করে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম হোসেন বলেন, গুলি করে রোহিঙ্গা নুর বশরকে হত্যা করা হয়েছে। একটি গুলি বুকের বাঁ পাশে এবং আরেকটি বাঁ পাশের কোমরে লাগে। ঘটনাস্থলে নুর বশরের মৃত্যু হয়েছে। পূর্বশত্রুতার জের ধরে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর ৩০-৪০ জনের একটি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গভীর রাতে নুর বশরকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ঘটনায় আজ বেলা তিনটা পর্যন্ত মামলা হয়নি। মামলার প্রস্তুতি চলছে।
অপর ঘটনায়, গতকাল দিবাগত রাত চারটার দিকে কুতুপালং (ক্যাম্প-৪ বর্ধিত) আশ্রয়শিবির থেকে তুলে নিয়ে আরসা সন্ত্রাসীরা গুলি ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে আরেক রোহিঙ্গা কবির আহমদকে (২৭)। রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, ভোর চারটার দিকে আরসার ১০-১২ জন সন্ত্রাসী কবির আহমদকে ঘর থেকে তুলে আশ্রয়শিবিরের পাশের লালপাহাড়ে নিয়ে যায়। এরপর ছুরিকাঘাত ও গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়।
উখিয়া থানার ওসি শামীম হোসেন বলেন, পূর্বশত্রুতার জেরে রোহিঙ্গা সশস্ত্রগোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরা কবির আহমদকে হত্যা করে। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ জানায়, গত ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে উখিয়ার তানজিমারঘোনা (ক্যাম্প-২০) আশ্রয়শিবিরের এম-২৫ ব্লকের মারকাজ মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আরএসও ও আরসার মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় আরসার দুজন ক্যাম্প কমান্ডার নিহত হন। নিহত দুজন হলেন উখিয়ার ২০ নম্বর আশ্রয়শিবিরে এম-২৫ ব্লকের বাসিন্দা আবুল কালামের ছেলে ইমাম হোসেন (৩৭) এবং মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৪) বি-৬ ব্লকের গনি মিয়ার ছেলে রহমত উল্লাহ (২৫)। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন উখিয়ার ২০ নম্বর আশ্রয়শিবিরে এম-২৯ ব্লকের হামিদ হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ (৩১)।
আশ্রয়শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এডিআইজি) মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, আশ্রয়শিবিরে আধিপত্য বিস্তার, মাদক চোরাচালানের টাকা ভাগাভাগি, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণের জন্য অপহরণ এবং পূর্বশত্রুতার জেরে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। প্রায় সময় অস্ত্রসহ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হয়।
রাখাইনে এখনো নিপীড়ন আর হত্যা চলছে
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাড়ে আট মাসে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ৫৮টি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৬৭ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন। অধিকাংশ খুনের ঘটনা আরসার সঙ্গে আরএসও ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে আরসার ২৩ সদস্য, আরএসওর ৭ জন সদস্য খুন হয়েছেন। আর গত সাত বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি এবং র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে একাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২৪৬ জন। ৭ বছরে ২৩৩টি খুনের মামলায় ১ হাজার ৬৪৮ জনকে আসামি করা হলেও অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ রোহিঙ্গা এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।