তারিনা ইয়াছমিন ঝরা
একটি জাতির বিবর্তনের অপরিহার্য উপাদান হলো শিক্ষা। রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র একক পরিবার থেকে বিশ্বপরিমণ্ডলে শিক্ষার প্রভাব বিস্তৃত। বাংলাদেশে শিক্ষার হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে; কিন্তু সে অনুযায়ী গ্রামের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে আছে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিত করা সম্ভব হলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রামের ছাত্রীরা এখনো অনেকটা পিছিয়ে। দেশের উন্নতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিবেচনায় গ্রামের নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়ার হার শহরের তুলনায় অনেক বেশি।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব’। উক্তিটিতে স্পষ্ট যে, নারীর শিক্ষার অগ্রাধিকার ঠিক কতটা সুউচ্চে। অথচ বর্তমানে নারীরা শিক্ষার দিকে এগিয়ে আসছেন ঠিকই; কিন্তু উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সামগ্রিক হারে এগোতে পারছেন না। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান বু্যরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরে ছাত্রীর হার ৫০ দশমিক ৭৫ শতাংশ, জুনিয়র স্কুলে (৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি) ৫৫ দশমিক ১৪ শতাংশ, মাধ্যমিকে (নবম থেকে দশম শ্রেণি ) ৫১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর পরই ছাত্রীদের সংখ্যা কমতে থাকে। উচ্চমাধ্যমিকে ছাত্রীর হার (একাদশ-দ্বাদশ) ৪৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ডিগ্রিতে ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ৩৬ দশমিক ০৭ শতাংশ।
গ্রামের নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নামক অগ্রযাত্রায় শামিল হতে না পারার পেছনে বহু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথমত, গ্রামীণ সমাজে নারী বৈষম্যমূলক প্রগাঢ় চিন্তাভাবনা। প্রান্তিক সমাজের বেশির ভাগ পরিবারসমূহে ভাবা হয় মেয়েরা ঘরের শোভা। কেবল সাক্ষর কিংবা সন্তানাদিকে অক্ষরজ্ঞান দিতে পারার সক্ষমতাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে নারীর শিক্ষা অর্জন মাধ্যমিকেই সমাপ্ত হয়। দ্বিতীয়ত, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান কুসংস্কারের প্রভাব। কিছু পরিবারের আর্থিক সংগতি থাকলেও ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার, অবরোধপ্রথা ইত্যাদির জন্য মেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষায় উৎসাহী করা থেকে বিরত রাখে।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত্ হোসেনের কথায়— ‘উড়তে শেখার আগেই পিঞ্জিরাবদ্ধ এই নারীদের ডানা কেটে দেওয়া হয় এবং তারপর সামাজিক রীতিনীতির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তাদের। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এই কার্যক্রমই চলছে। ধর্মের রীতিনীতিকে নিজেদের মতো বানোয়াট রূপ দিয়ে নারীদের উচ্চশিক্ষা থেকে বিরত রাখতে সদা প্রস্ত্তত এক শ্রেণির লোক। প্রান্তিক এলাকাসমূহে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নারীকে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। তৃতীয়ত, বাল্যবিবাহ গ্রামের নারীদের উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রতিবন্ধকতার নাম।
একবিংশ শতাব্দীর এই লগ্নে এসেও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে মেয়েদের ১৮ বছরের পূর্বে সাবালিকা হলেই বিয়ে দেওয়া হয়। আর বিয়ের পরে পড়াশোনা চলমান থাকে, এমন শিক্ষার্থী খুবই কম। প্রায়শই স্বামীদের উদার মন-মানসিকতার অভাবে নারীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয় না। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাল্যবধূর সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ। চতুর্থত, প্রান্িতক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব শীর্ষক তথ্যের অভাব। আমাদের দেশে আনাচকানাচ এমন অনেক গ্রাম আছে, যারা জানেনই না যে, নারীদের উচ্চশিক্ষার জায়গা কতটা সুপ্রশস্ত। যার দরুন তারা মেয়ে সন্তানকে শুধুই গৃহস্থালি কাজে পারদর্শী করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পঞ্চমত, সরকারি সাহাঘ্যের অপ্রতুলতা। একজন শিক্ষার্থীর স্কুল-কলেজে উৎসাহমূলক সরকারি সহায়তা পেলেও এরপর উচ্চশিক্ষা অর্জন প্রক্রিয়ায় ভীষণ বেগ পোহায়। উচ্চ মাধ্যমিকের পর কোচিং করানো কিংবা হোস্টেলে রেখে পড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক অভিভাবক আর্থিক অভাবে পিছিয়ে যান এবং নিরাপত্তা নিয়েও দ্বিধায় থাকেন।
একটি পরিবারের সুরক্ষায় একজন উচ্চশিক্ষিত নারী একটি সুরক্ষিত দুর্গের মতো কাজ করেন। এছাড়া পরিবারের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নেও তাদের অনবদ্য অবদান। গ্রামের একজন শিক্ষার্থীর মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা বিকাশের অনিবার্য ধাপ উচ্চশিক্ষা অর্জন। তাই গ্রামে নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় উৎসাহী করার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে নারীদের উচ্চশিক্ষাচর্চার সুযোগ করে দিলে ক্রমান্বয়ে গ্রামের মেয়েরা উৎসাহিত হবে। গ্রামাঞ্চলে বৈষম্যহীন সাম্যনীতি গড়ে তুলতে পারলেই কেবল নারীরা উচ্চশিক্ষার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্ত্ততি নেবে। তাই নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে একটি সুস্হ ও অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়