জয় বাংলাদেশ: পুরোপুরি বদলে গেছে জম্মু–কাশ্মীরের ভোট–ছবি। বিশেষ মর্যাদা হারানো এই রাজ্যের ভোট এবার নতুন চমক জাগায় কি না, সেই আগ্রহ জেগে উঠেছে। ১০ বছর পর জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভার ভোট হতে চলেছে। শেষবার হয়েছিল ২০১৪ সালে। বিজেপি–পিডিপি মিলে সরকার গড়েছিল, যার পতন ঘটে ২০১৮ সালে। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। জম্মু–কাশ্মীর শুধু রাজ্যের মর্যাদাই হারায়নি, হারায় তার বিশেষ চরিত্রও। খারিজ হয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ।
১০ বছর আগের তুলনায় এবারের ভোট–চরিত্র পুরোপুরি আলাদা। কেননা, দীর্ঘ ৩৭ বছর পর এই প্রথম জামায়াতে ইসলামির (জেআই) সাবেক নেতারা বিধানসভার ভোটে নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষায় নেমে পড়েছেন। সেই সিদ্ধান্ত জন্ম দিয়েছে বহু অভিযোগ ও প্রশ্নের। উপত্যকার রাজনৈতিক নেতাদের ধারণা, ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে এটা বিজেপির নবতম চাল।
সত্যি বলতে কি, এবারের ভোটের প্রধান আকর্ষণ জামায়াত। জম্মু–কাশ্মীরে জামায়াত শেষবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল ১৯৮৭ সালে। বিধানসভার সেই ভোট এখনো কারচুপির জঘন্যতম নিদর্শন বলে চিহ্নিত। সেই ভোটে জামায়াত লড়েছিল মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের (এমইউএফ) ব্যানারে। প্রবল আশা ও প্রচুর উদ্দীপনা সত্ত্বেও সেবার জামায়াতের প্রার্থীরা জিতেছিলেন মাত্র ৪টি আসন, যদিও মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট ভোট পেয়েছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। তাদের চেয়ে মাত্র ১ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে কংগ্রেস সেবার জিতেছিল ২৬টি আসন, ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) পেয়েছিল ৪০টি আসন। এনসি পেয়েছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোটারের সমর্থন।
পরে জামায়াত যোগ দিয়েছিল হুরিয়ত কনফারেন্সের সঙ্গে। ডাক দিয়েছিল ভোট বর্জনের। একসময় নিষিদ্ধও ঘোষিত হয় জামায়াত, এখনো নিষিদ্ধ। সম্প্রতি সেই নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো হয়েছে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। অথচ সরকারি উৎসাহ, উদ্যোগ ও মদদেই এবার তারা নির্বাচনের শরিক—যদিও নিজেদের সংগঠনের ব্যানারে নয়, স্বতন্ত্র হিসেবে। বিতর্ক সৃষ্টি করেছে সেই সিদ্ধান্তই।
উপত্যকায় এনসি, কংগ্রেস ও পিডিপির কর্তৃত্ব খর্ব করতে কেন্দ্রীয় সরকার জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চেয়েছিল। শর্ত ছিল, ভারতীয় সংবিধান মেনে নিয়ে তাদের নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে। জামায়াত রাজিও হয়েছিল। বেরিয়ে এসেছিল হুরিয়ত কনফারেন্সের ছত্রচ্ছায়া থেকে। কিন্তু আরএসএসের আপত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার তা পারেনি। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে তারা নির্বাচনের আসরে নেমেছে। তিন সাবেক নেতা তালাত মজিদ, সায়ার আহমেদ রেশি ও নাজির আহমেদকে তারা প্রথম পর্বের ভোটে মনোনয়ন দিয়েছে। সমর্থন জানিয়েছে আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আজাজ আহমেদকেও, পিডিপি এবার তাঁকে টিকিট দেয়নি। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়েই উপত্যকার প্রথম পর্বের ভোট সরগরম।
আগ্রহ ও উত্তেজনার আরও এক কারণ পরিচিত কারাবন্দী ইঞ্জিনিয়ার রশিদ। দিল্লির তিহার জেলে বন্দী থেকেও তিনি লোকসভা ভোটে হারিয়ে দেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও এনসির সহসভাপতি ওমর আবদুল্লাহকে। ২ লাখের বেশি ভোটে তাঁর জয় উৎসাহিত করেছে জামায়াত ও অন্যদের, যারা প্রথাসিদ্ধ রাজনীতির বিরোধিতা করার কারণে মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে এত বছর।
বিজেপিও উপত্যকার ভোটে এদেরই টেনে আনতে উৎসাহিত হয়েছে, যাতে মুসলমান সমর্থন নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ইঞ্জিনিয়ার রশিদ গড়ে তুলেছেন নিজের দল আওয়ামি ইত্তেহাদ পার্টি (এআইপি)। তাঁর ভাই খুরশিদ আহমেদ শেখ সরকারি স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
বিজেপির এই নীতিকেই আক্রমণ করেছেন ওমর আবদুল্লাহ। গত রোববার শ্রীনগরে আবদুল্লাহ পরিবারের ‘খাসতালুক’ বলে পরিচিত গান্দারবাল নির্বাচনী কেন্দ্রে এক জনসভায় বিজেপিকে আক্রমণ করে তিনি বলেন, উপত্যকায় তাঁকে ও তাঁদের মতো জাতীয়তাবাদী দলগুলোকে হারাতে বিজেপি হাত মিলিয়েছে তাদের (জামায়াত) সঙ্গে, যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আসরে নেমেছেন। বিজেপি ভাবছে, জম্মুর হিন্দু সমর্থনে ভর দিয়ে ও উপত্যকার এই শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়বে। জম্মু–কাশ্মীরকে উপহার দেবে প্রথম হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী।
এটাই এবারের ভোটের চমক। আর এই চমকই হয়ে উঠতে পারে উপত্যকার চিরায়ত রাজনীতির পরিবর্তনের শুরু। দক্ষিণ কাশ্মীরের কুলগাম কেন্দ্রের বোগাম গ্রামে রোববার এক জনসভায় যোগ দেন জামায়াতের স্বতন্ত্র প্রার্থী সায়াদ আহমেদ রেশি। এই কেন্দ্র থেকে বারবার বিধানসভায় জিতে এসেছেন সিপিএম নেতা এম ওয়াই তারিগামি। এবারও তিনিই প্রার্থী। লড়ছেন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রার্থী হিসেবে, এনসি–কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে। তারিগামির চ্যালেঞ্জার রেশি। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, এতকালের প্রথামাফিক রাজনীতি একটা গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। সেই শূন্যতা ভরাট করাই তাঁদের লক্ষ্য।
ভোটের ঘোষণার পর জামায়াত এত দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালাচ্ছিল। গতকাল রোববার বোগাম গ্রামে তারা প্রকাশ্য সমাবেশ করে। সেখানে জনসমাগম ছিল বিস্ময়কর। এই সমর্থনই তাঁদের শক্তি জানিয়ে রেশি বলেন, কিছু মানুষ এখনো তাঁদের দিকে আঙুল তুলবেন। তাঁদের এতকালের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। কিন্তু তাঁরা বাস্তবতার দিকে তাকিয়েই ভোটে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জামায়াতের নেতারা জানিয়েছেন, উপত্যকার মানুষের সম্মান প্রতিষ্ঠায় যাঁরা কাজ করবেন, তাঁরা সেই দলকেই সমর্থন করবেন।
প্রশ্ন উঠেছে, যাঁরা এতকাল উপত্যকায় রক্তপাত ঘটিয়েছেন, তাঁদের কী করে কেন্দ্রীয় সরকার মদদ দেয়? কোন লক্ষ্যে? কী উদ্দেশ্যে?
ওমর আবদুল্লাহরাও প্রতিটি জনসভায় এই প্রশ্নই তুলে যাচ্ছেন। বিজেপির উত্তর, অস্ত্র ছেড়ে যাঁরা রাজনীতির মূলধারায় ফিরতে আগ্রহী, তাঁদের সুযোগ দেওয়া উচিত।
পরিবর্তিত জম্মু–কাশ্মীরে এটাই পরিবর্তনের হাওয়া কি না, বোঝা যাবে অক্টোবরে। তিন ধাপে ১৮ সেপ্টেম্বর, ২৫ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর ভোট গ্রহণ শেষে ৪ অক্টোবর ফল ঘোষণা করা হবে।