Tuesday, November 19, 2024
Google search engine
Homeস্বদেশ সংবাদবাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি : চিকিৎসা সংকটে বন্যার্তরা

বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি : চিকিৎসা সংকটে বন্যার্তরা

জয় বাংলাদেশ : ফেনীর দুর্গত এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। বেরিয়ে আসছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন। সঙ্গে দেখা দিচ্ছে রোগব্যাধি। ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ জ্বর, সর্দি–কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছে বন্যার্ত এলাকার মানুষ। অনেকের হাতে–পায়ে ঘা, খোস–পাঁচড়া দেখা দিচ্ছে।

৯ দিন ধরে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করায় ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লায় বয়স্ক ও শিশুরা জ্বর, সর্দি–কাশি ও ডায়রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বন্যার্তরা বলছেন, চারদিক এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। বন্ধ আছে অনেক কমিউনিটি ক্লিনিক। পর্যাপ্ত ওষুধপত্র ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতে ১১ জেলায় ৬১৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। এদিকে বন্যায় মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেড়েছে। গতকাল বুধবার দুপুর পর্যন্ত ৩১ জন মারা গেছেন বলে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ তথ্যে জানানো হয়েছে।

এদিকে মঙ্গলবার ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে ত্রাণবাহী গাড়ির দীর্ঘ জটলা দেখা দেয়। এতে যাত্রাবাড়ী থেকে মদনপুর পর্যন্ত মহাসড়কের ১৫ কিলোমিটার অংশে যানজট দেখা দেয়। অবশ্য বিকেলের দিকে সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসে।

বেশি আক্রান্ত শিশুরা
ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলায় বন্যার পানি নামছে ধীরগতিতে। ফেনীর বিভিন্ন দুর্গম গ্রামের স্থায়ী-অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া দুর্গত মানুষের কাছে চিকিৎসাসেবা পৌঁছাচ্ছে না। বেশির ভাগ কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ। গত দুদিনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো চালু হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ স্থায়ী-অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে স্বাস্থ্যকর্মীরা পৌঁছাতে পারছেন না। এতে শিশুদের নিয়ে বিপাকে আছেন অভিভাবকেরা।

গত তিন দিন ফেনী সদরের ফাজিলপুর, লেমুয়া, ছাগলনাইয়ার বিভিন্ন এলাকার ছয়টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, শিশুরা জ্বর ও সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত।

ফেনী সদর উপজেলার ১০ নম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের উত্তর টংগিরপাড় হাজী বাড়ি মসজিদ এলাকায় বাড়ি তানিয়া আক্তারের। তাঁর চার বছরের মেয়ে বর্ণমালা চার দিন ধরে জ্বর, সর্দি–কাশিতে আক্রান্ত। তাঁর বাড়িঘরের আশপাশ এখনো ডুবে আছে। পথঘাট দেখা যাচ্ছে না। মেয়েকে চিকিৎসকের কাছে নিতে পারছেন না।

কোনো স্বাস্থ্যকর্মী তাঁদের এলাকায় যাননি এখনো। ২১ আগস্ট রাতে তাঁরা আশ্রয় নেন স্থানীয় একটি মসজিদে। সেখানে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ছিলেন। এর মধ্যে বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ভেজার কারণে বর্ণমালার জ্বর আসে। বাসায় কোনো ওষুধও ছিল না। তাই মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

পানির কারণে গ্রামে গ্রামে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ফেনী জেলার সিভিল সার্জন শিহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশির রোগী তাঁরা বেশি পাচ্ছেন। শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে ছয় উপজেলায় ছয়টি জরুরি দল গঠন করা হয়েছে। ক্যাম্পের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

নোয়াখালীতে আশ্রয়কেন্দ্রে ও পানিবন্দী বাড়িঘরে শিশুদের অসুস্থতা বাড়ছে। বন্যার পানি বসতঘরে ঢুকে পড়ায় ৯ দিন আগে দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন হেলাল উদ্দিন (২৮)। দুই বছরের ছেলে নাহিদ এক সপ্তাহ ধরে জ্বর ও সর্দিতে শয্যাশায়ী। ধার করে টাকা নিয়ে বাজার থেকে ওষুধ এনে খাইয়েছেন। এখনো কোনো উন্নতি নেই। এরই মধ্যে গতকাল একজন ডাক্তার (মেডিকেল টিমের সদস্য) এসে ক্যাপসুল দিয়ে গেছেন। কিন্তু বাচ্চা ক্যাপসুল খেতে চায় না। এখন কী করবেন, বুঝতে পারছেন না নোয়াখালী সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের চর দরবেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া হেলাল উদ্দিন।

জেলা সিভিল সার্জন মাসুম ইফতেখার বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষজনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ৮৮টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। তারা প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দুর্গত মানুষকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, খাওয়ার স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ দিচ্ছেন।

পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত ওষুধ
দূষিত পানি পান ও বন্যার পানি মাড়িয়ে চলাফেরা করার কারণে পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন লক্ষ্মীপুরের বন্যার্ত মানুষজন। এ অবস্থায় দুর্গত এলাকার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ বরাদ্দ চেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত ৫০ হাজার ওরস্যালাইন পাওয়া গেছে।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, বানভাসিদের চিকিৎসাসেবা দিতে লক্ষ্মীপুরে ৬৩টি ও একটি বিশেষ মেডিকেল টিম কাজ করছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের ৪০টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও তিনটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র পানিতে ডুবে গেছে।

সদর উপজেলার জয়পুর এলাকার বানভাসি কোহিনুর বেগম (৪৫) জানান, এ গ্রামের অনেক বসতভিটায় এখনো বন্যার পানি। এ পানির ভেতরেই তাঁদের চলাচল করতে হচ্ছে। এতে তাঁর হাতে-পায়ে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। গ্রামের সব পরিবারেই কোনো না কোনো রোগ দেখা দিয়েছে বলেও জানান তিনি।

লক্ষ্মীপুরের সিভিল সার্জন আহাম্মদ কবীর বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা নৌকায় করে দুর্গম এলাকায় বানভাসিদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিচ্ছেন।

কুমিল্লায় ৭২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। বয়স্ক ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে ২০৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। তবে দুর্গম গ্রামে এখনো কোনো মেডিকেল টিম যায়নি। চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না সেসব এলাকার বন্যাকবলিত মানুষ।

কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার উত্তরের শেষ প্রান্ত রসুলপুর গ্রাম। গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, নালার ময়লা–আবর্জনা ও শৌচাগারের বর্জ্যে দূষিত হয়ে আছে পুরো গ্রাম।

পায়ে ফোড়া উঠেছে ওই গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহীনের। দুই পায়ে ফোড়া ও ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে শাহীন বললেন, ‘আমাদের মতো বয়স্কদের পায়ে ফোড়া উঠেছে। ছোটদের অবস্থা আরও বিপজ্জনক। এই গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকে এখনো সেভাবে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাচ্ছে না।’

কুমিল্লার ডেপুটি সিভিল সার্জন নাজমুল হোসাইন জানান, বন্যাকবলিতদের জন্য ২০৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকায় সেবা দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে।

বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ৩১
গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বন্যায় মৃত্যুর তথ্য তুলে ধরেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত ১১টি জেলার ৭৩টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত। জেলাগুলো হলো ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট। এর মধ্যে কুমিল্লায় ১২, চট্টগ্রামে ৫, নোয়াখালীতে ৬, কক্সবাজারে ৩, ফেনীতে ২, খাগড়াছড়িতে ১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ ও লক্ষ্মীপুরে ১ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া মৌলভীবাজারে দুজন নিখোঁজ আছেন।

সর্বশেষ প্রাপ্ত হালনাগাদ (বুধবার বেলা একটা পর্যন্ত) তথ্য অনুযায়ী, এখনো ১২ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৪টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে আছে, যা আগের দিন ছিল ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৭৩৪। এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৪ হাজার ৩টি। এগুলোতে ৫ লাখ ৪০ হাজার ৫১০ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

‘ত্রাণবাহী গাড়ির চাপে’ যানজট
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ‘ত্রাণবাহী ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানের চাপে’ প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়। গতকাল ভোরে শুরু হওয়া এই যানজট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে শুরু হয়ে নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে চট্টগ্রামমুখী লেনে গিয়ে শেষ হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রাবাড়ী অংশে যানজট কমে এলেও মদনপুর থেকে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা পর্যন্ত যানজট ছড়িয়ে পড়ে। বিকেল পর্যন্ত মহাসড়কের এই অংশে যানজট ছিল ও থেমে থেমে যান চলাচল করেছে। এতে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েন ওই পথের যাত্রী ও চালকেরা। বিকেল চারটার পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

 

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

নতুন সংবাদ

Recent Comments