জয় বাংলাদেশ: জীবন যাত্রার বাড়তি খরচ, রপ্তানি কমে যাওয়া ও ডলার সংকটের কারণে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিল করছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এবার মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাড়িঁয়েছে কোটা আন্দোলনকে ঘিরে স্থবির অবস্থা, চলমান কারফিউ । যদিও কারফিউর কারণে বন্ধ থাকা শিল্পকারখানা চালু হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি ফিরতে শুরু করেছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য এখনো আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। দিনের বেলায় ৭-৮ ঘণ্টা ছাড়া অন্য সময় কারফিউ বলবৎ থাকার পাশাপাশি সীমিত ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং কার্যক্রমের কারণে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটিসহ টানা পাঁচ দিন ব্যাংক বন্ধ থাকার পর গত বুধ ও বৃহস্পতিবার চার ঘণ্টা করে সীমিতসংখ্যক শাখা খোলা ছিল। এ সময় টাকা তুলতে গ্রাহকদের চাপ ছিল। যদিও টাকা জমা দেওয়া ও তোলা ছাড়া ব্যাংকে অন্য কার্যক্রম তেমন একটা ছিল না। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। পণ্য রপ্তানি শুরু হয়েছে। আমদানি পণ্য খালাসে চাপ বেড়েছে। এতে বন্দরের ভেতরে সারাক্ষণই গাড়ির জট লেগে থাকছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৫ জুলাই শুরু হওয়া সহিংসতা পরে আরও বাড়ে। ১৮ জুলাই রাতে ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার পর আমদানি ও রপ্তানিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়। এরপর ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করা হলে অধিকাংশ শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে গত মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) থেকে চট্টগ্রামের শিল্পকারখানা খোলার অনুমতি দেয় সরকার। আর বুধবার ঢাকা মহানগর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহের ভালুকাসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানায় উৎপাদন শুরু হয়। অধিকাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দেন।
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক ও জুতা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর প্লাস্টিক পণ্য, ইস্পাত, সিমেন্ট ও ভোগ্যপণ্য খাতের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলছেন, কারখানার উৎপাদন শুরু হলেও আমদানি হওয়া কাঁচামাল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আসা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পণ্য পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মিলছে না; সে কারণে ভাড়াও বেশি। সীমিত ইন্টারনেটের কারণে ডিজিটাল মাধ্যমে ক্রয়াদেশ নিতে সমস্যায় পড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার সীমিত ব্যাংকিং কার্যক্রমের কারণে অর্থ লেনদেনেও সমস্যা হচ্ছে।
সীমিত ইন্টারনেটের কারণে ক্রয়াদেশ নিতে পারছেন না কর্মীরা। আবার ইন্টারনেট না থাকায় উপজেলা পর্যায়ের অনেক ব্যাংক সেবা দিতে পারছে না। ফলে অর্থ লেনদেন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কাঁচামালের চালান স্থগিত করছে বা পিছিয়ে দিচ্ছে।
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (সিইপিজেডে) প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের নয়টি তৈরি পোশাক কারখানা গত বুধবার চালু হয়েছে। গত দুই দিনে কারখানাগুলোতে উৎপাদন ছিল স্বাভাবিক। তবে কোম্পানিটির একজন শীর্ষ নির্বাহী বলেছেন, কারফিউর কারণে গত চার দিন কাজ না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় উৎপাদন পিছিয়ে পড়েছে, এখন সেই জট স্বাভাবিক করতে দুই মাস লাগবে।
প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘কারখানা বন্ধ থাকায় আমরা বেশ কিছু ক্রয়াদেশের পণ্য সময়মতো জাহাজিকরণ করতে পারিনি। আবার উৎপাদনে পিছিয়ে গেছি। ইন্টারনেট সচল হওয়ার পর ক্রেতাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ শুরু করেছি। কিছু ক্রয়াদেশে হয়তো আমাদের মূল্যছাড় দিতে হবে। কিছু পণ্য হয়তো নিজেদের খরচে উড়োজাহাজে পাঠাতে হবে। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে।’
কারফিউর কারণে বন্ধ থাকা নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশন কারখানা দুই দিন আগে উৎপাদনে ফিরেছে। এই কারখানায় এখন উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে। তবে চীন থেকে আমদানি হওয়া ৮ কনটেইনার কাপড় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কারখানায় আনতে জটিলতায় পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘সরকারের সাধারণ ছুটি, কারফিউ ও ইন্টারনেট না থাকায় বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তারপরও কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে পোর্ট ডেমারেজ চার্জ হিসেবে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা দাবি করছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই মাশুল দিতে হবে না। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের আবেদন করতে পরামর্শ দিয়েছে।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন ‘হয়রানি’ বন্ধ চান তিনি।
গাজীপুরের টঙ্গীতে ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের প্লাস্টিক পণ্যের কারখানার উৎপাদন কাঁচামালের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে যে কাঁচামাল, তা দিয়ে চার-পাঁচ দিন চলবে। তাদের ৯০ কনটেইনার পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে আছে। উৎপাদনের পাশাপাশি পণ্য বিক্রিতেও সমস্যা হচ্ছে। সীমিত ইন্টারনেটের কারণে অনলাইনে ক্রয়াদেশ নেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ক্রয়াদেশ নিয়ে অফিসে পাঠাতে পারছেন না কর্মীরা। আবার সীমিত ব্যাংকিংয়ের কারণে টাকা জমা দিতে সমস্যা হচ্ছে। সব মিলিয়ে নগদ অর্থের প্রভাবে টান পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ কমপক্ষে এক মাস পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করেন তিনি।
নির্মাণসামগ্রী খাতে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আনোয়ার গ্রুপের ব্যবসা বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০-২৫ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানান কোম্পানিটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। কাঁচামালের অভাবে এই কোম্পানির বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন বলেন, সীমিত ইন্টারনেটের কারণে ক্রয়াদেশ নিতে পারছেন না কর্মীরা। আবার ইন্টারনেট না থাকায় উপজেলা পর্যায়ের অনেক ব্যাংক সেবা দিতে পারছে না। ফলে অর্থ লেনদেন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কাঁচামালের চালান স্থগিত করছে বা পিছিয়ে দিচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতির কারণে নিত্যব্যবহার্য এবং ভোগ্যপণ্য প্রস্তুত ও বাজারজাতকারী বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশের পণ্য বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। যদিও তাদের কারখানার পণ্য উৎপাদন প্রায় স্বাভাবিক রয়েছে।
অন্যদিকে তিন কার্যদিবস বন্ধ থাকার পর বৃহস্পতিবার চালু হয় পুঁজিবাজার। যদিও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমে এবং প্রায় দেড় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়।
আরেকদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দোকানপাট খুললেও ক্রেতাদের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি। ফলে, ব্যবসায়ীরা হতাশা প্রকাশ করেন। ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে অবস্থিত নূরজাহান সুপার মার্কেটের কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী আলম শেখ বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতিতে মানুষ বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। এ কারণে ক্রেতার উপস্থিতি তুলনামূলক কম।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারকে এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করার দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশের অর্থনীতি সংকটের মধ্যে রয়েছে। নতুন করে গভীর রাজনৈতিক সংকট সামনে এসেছে। ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করতে ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং কবে থেকে ঠিকঠাকভাবে কাজ করবে, তা সুস্পষ্টভাবে সরকারকে জানাতে হবে। একই সঙ্গে সামগ্রিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ওপর আগামী দিনের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ভর করে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত কয়েকদিনে প্রতিদিন প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি। কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে।’ তিনি বলেন, ‘সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্ন ঘটলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, যা ইতোমধ্যে উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।’
তার ভবিষ্যদ্বাণীর পেছনে একটি শক্ত ভিত্তি রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নয় দশমিক সাত তিন শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং সরকারের সাত দশমিক পাঁচ শতাংশের চেয়ে বেশি। আহসান এইচ মনসুর সতর্ক করে বলেন, সাম্প্রতিক এই সংকটের কারণে বাংলাদেশ রপ্তানি আদেশ হারাতে পারে।