আলতাফ হোসেন হৃদয় খান
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর জীবন বাজি রাখার ঘটনাও বিরল নয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। এর একটি কারণ হতে পারে নিম্নবর্গের নারীদের ব্যাপকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ।
নারীর এই ভূমিকা সুশীল সমাজের কাছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করে স্বাধীনতার তিন দশক পরে। নারীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক শক্তি ছিল। কখনো সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনো বা যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে থেকে। তাদের বিশ্বাস ছিল অবিচল, সাহস ছিল সুকঠিন। তারামন বিবির মতো বহু মুক্তিযোদ্ধা আছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যাও অসংখ্য। অজানা-অচেনা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন বহু নারী নিজের শ্রম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছেন কখনো মমতাময়ী মায়ের মতো, কখনো বা বোনের মতো। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন। পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
পুরুষের পাশাপাশি সেদিনের নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা এবং সাহসের ফল এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতাযুদ্ধে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। যেমন কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা। তাঁদের মতো অনেক নারী সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের খতম করেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গোবরা ক্যাম্পে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক নারী। কলকাতার পার্ক সার্কাস ও পদ্মপুকুরের মাঝামাঝি গোবরা নামের স্হানে শুধু নারী যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি ট্রেনিং ক্যাম্প স্হাপন করা হয়েছিল। সেটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
নারী যোদ্ধাদের জন্য অনুরূপ আরো তিনটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। গোবরা ক্যাম্পে মেয়েদের দেওয়া হতো তিন রকম ট্রেনিং—১. সিভিল ডিফেন্স, ২. নার্সিং, ৩. অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। সিভিল ডিফেন্সের প্রশিক্ষক ছিলেন শিপ্রা সরকার ও সেবা চৌধুরী। নার্সিং শেখাতেন ডা. মীরালাল ও ডা. দেবী ঘোষ। অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ কৌশল শেখাতেন ক্যাপ্টেন এস এম তারেক ও মেজর জয়দীপ সিং। ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসংখ্য নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা দিয়েছেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী শিল্পী। পথে-প্রান্তরে অলিগলিতে গান গেয়ে তাঁরা অর্থ সংগ্রহ করে সেই অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ব্যয় করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, শান্তিকমিটি, রাজাকারবাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এ দেশের গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, বন্দরে অসংখ্য নারী কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু আশ্রয় দেওয়াই নয়, তাদের অস্ত্র বহন করেছেন, লুকিয়ে রেখেছেন, গোপন সংবাদ আনা-নেয়া করেছেন। দেশমাতার জন্য নিজের সন্তান, স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধার সারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের আশি শতাংশ নারী হয়তো এই শ্রেণিতে পড়েন।
পাকিস্তাানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এ দেশের প্রায় তিন লাখ নারী। এদের মধ্যে অনেকে শহিদ হয়েছেন, অনেকে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা সহ্য করেও প্রাণে বেঁচে গেছে। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েও নৈতিকভাবে পরাজিত হননি। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও এরা স্বামী, পুত্র, ভাইকে দেননি শত্রুর হাতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনেও কাজ করেছেন অনেক নারী।