শহিদুল আলম: তাহরির স্কয়ারের সমতুল্য বাংলাদেশের শাহবাগ। সেখানে প্রতিবাদ বিক্ষোভে যোগ দিয়ে আমরা কারফিউ ভঙ্গ করেছি। আহত বন্ধুদের অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানিয়ে এসেছি। জানি না তাদের সঙ্গে এটাই শেষ দেখা হবে কিনা। ছাত্র, শিক্ষক ও সাংবাদিকদের প্রায় ২০ জনের ছিল আমাদের গ্রুপ। তাতে প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ে পুলিশ। গুলিবিদ্ধ হয় তিনজন। তাদেরকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমার পার্টনার ও আমি সাহসী এক রিকশাচালককে রাজি করাই আমাদেরকে শাহবাগে নিয়ে যেতে। ঢাকার সংকীর্ণ ক্ষতবিক্ষত সড়ক দিয়ে আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছি, তখন বাংলাদেশের (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর পৌঁছে গেছে শাহবাগে। সেনারা তাদের অস্ত্র নিবৃত করেছেন। উদ্বেলিত তরুণ, যুবকরা তাদের সাঁজোয়া যানের উপর উঠে গেছে। উল্লাসে ফেটে পড়া এই জনতার সামনে রয়েছে সেই সব সাঁজোয়া যান। এটা ছিল ৫ই আগস্ট। এর আগে কয়েক দিনে আমাদের দিকে তাক করা ছিল নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের অস্ত্র।
দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান দুটি বাংলাদেশ। এর প্রথম গ্রুপটি হলো দরিদ্র থেকে ধনী হওয়া একটি দেশের অসম্ভাব্য একটি কাহিনী। বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত জাতীয় প্রবৃদ্ধির অন্যতম তারা। এই বাংলাদেশের নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী একজন নারী সরকার প্রধান হাসিনা। অন্য অংশটি একটি দীর্ঘ সহনশীল জনগণকে নিয়ে গঠিত। তারা স্পষ্টতই দূরদর্শী নেতার ঝাঁকুনির নিচে ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন নির্মম স্বৈরাচারী। তার পথে যিনি দাঁড়িয়েছেন তিনি তাকেই জেলে ঢুকিয়েছেন, গুম করেছেন অথবা হত্যা করেছেন। তার শাসনের অধীনে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল এক বিপজ্জনক বাইনারি দেশ। আপনাকে হয়তো তার তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগার হতে হবে আর তা নাহলে আপনাকে রাজাকার ঘোষণা দেয়া হতো, সহযোগী ঘোষণা দেয়া হতো। এভাবেই রাষ্ট্রের শত্রু হয়ে যেতেন। তখনকার ক্ষমতাসীন দলের অভিজাত এবং তার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, যারা তাদেরকে সার্ভ করেছে- তারা সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের উন্নয়নের মিরাকল। বৃদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক মহল এবং কিছু ‘হোয়াইট কলার’ পেশাদাররা এর চারপাশে ঘিরে ছিলেন। তারা সুবিধা পাওয়ার বিনিময়ে তাদেরকে অনুমোদন দিতেন। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ভারতের (প্রধানমন্ত্রী) নরেন্দ্র মোদি। দুর্নীতি ছিল এর আদর্শ। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে সম্পদ বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন এখানকার অতি ধনীরা। বিশ্বে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারী আমাদের দেশ। এটা হয়ে ওঠে উচ্চ মূল্যের দেশ এবং চকচকে কিছু শপিং সেন্টারের দেশ হয়ে উঠেছিল।
অন্য বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিল দুর্ভাগা খেটে খাওয়া মানুষকে নিয়ে। এর মধ্যে আছেন গার্মেন্টস শ্রমিক, অভিবাসী শ্রমিক এবং কম মজুরিতে কাজ করা আরও লাখ লাখ মানুষ। অনেক ক্ষেত্রে তারা অমানবিক পরিবেশে বসবাস করেন। তারা ধনীদের পকেট ভারী করার হাতিয়ার ছিলেন। নাজুক পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা সংবলিত বস্তিতে বসবাস করে অসংখ্য মানুষ। তাদের বেশির ভাগই মাস শেষে প্রায় ১১৩ ডলারের সম পর্যায়ের বেতন নিয়ে ঘরে ফেরেন। এই অর্থ দিয়ে একটি পরিবারকে খাওয়ানো-পরানো খুবই কঠিন। বিস্ময়ের কিছু নয় যে, যেসব বাজারে গার্মেন্ট শ্রমিকরা কেনাকাটা করেন সেখানে ১০ থেকে ১৫টি পরিবার নিয়মিত একত্রিত হয়ে পচে যাওয়া সবজি একসঙ্গে কেনেন।
এই দুই বাংলাদেশের মধ্যকার ব্যবধান জাতিকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল।
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক নিয়েই ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ ধরায়। সেই প্রতিবাদ বিক্ষোভ জুলাইয়ে দেশকে কাঁপিয়ে দেয়। এই পদ্ধতিতে দেশ স্বাধীন করার জন্য যেসব মুক্তিযোদ্ধা আছেন, তাদের উদ্দেশ্যেই এই কোটা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও এই ব্যবস্থা বিদ্যমান। এতে বৈধ আবেদনকারীদের অস্বীকার করে সরকারের অনুগতদের সুবিধা দেয়ার জন্য বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছিলেন ছাত্ররা। কিন্তু সহিংসতার মাধ্যমে ছাত্রদের সেই বিক্ষোভ দমাতে ব্যর্থ হয়ে হাসিনা কোটা ব্যবস্থাই পুরো বাতিল করে দেন। কিন্তু গত ৫ই জুন আদালত এই কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দেয়ার ফলে ছাত্ররা আবার ফুঁসে ওঠেন। তারা শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে বিক্ষোভ করছিলেন। কিন্তু সরকার তার জবাব দিয়েছে সহিংসতার সঙ্গে। এবার তারা বন্দুকের গুলি ছুড়েছে। এর পরের দিনগুলোতে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা হত্যা করে কমপক্ষে ৬ শিক্ষার্থীকে।
অনেক আগেই সরকারি চাকরিতে সুষ্ঠুভাবে সুযোগের দাবিতে মর্যাদা ও মৌলিক অধিকারের পক্ষে ব্যাপক আকার ধারণ করে আন্দোলন। ১৫ বছর ধরে ভয় ও নিষ্পেষণ নীতি হাসিনার জন্য কাজ করেছে। কিন্তু জনগণ যখন সাহস দেখিয়ে রাজপথে বুলেট মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়েছে, তারা জেনে গেছে আর পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। ছাত্রদের প্রধান দাবি ছিল হাসিনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। এই সাধারণ বিষয়টি হয়তো তাকে রক্ষা করতে পারতো। পক্ষান্তরে তার অভিমান হয়তো তার বিনাশের কারণ হিসেবে দেখা হবে। কিন্তু জনগণই সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যে সহিংস নিষ্পেষণ চালানো হয় তাতে কয়েক শত মানুষ মারা যান। আহত হন বহু হাজার মানুষ। এটা আড়াল করতে ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া হয়। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ২৫ বছর বয়সী আবু সাঈদের দু’হাত প্রসারিত করার ছবি পুরো বাংলাদেশের সামষ্টিক স্মৃতিতে খোদাই হয়ে গেছে। এরপরই বুলেট তাকে বিদ্ধ করে নিঃশেষ করে দেয়। ১৬ই জুলাই তার মৃত্যুর এই ভিডিও ভাইরাল হয়। ছাত্ররা শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি তোলেন।
খেটে খাওয়া পিতামাতার ছেলে আবু সাঈদ। তিনি ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বাংলাদেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাশাপাশি তার পরিবারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য প্রাইভেট পড়াতেন। আবু সাঈদের মতো মানুষের জন্য সরকারি চাকরি হলো সামাজিক মই বেয়ে উপরে উঠার কয়েকটি পথের মধ্যে একটি। তার মতো মানুষরাই এই প্রতিবাদ বিক্ষোভের সামনের সারিতে ছিলেন। অন্য সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তাদের সামনে অন্য বিকল্প আছে। তা হলো- বিদেশ যাওয়া, উচ্চ মার্কের করপোরেট চাকরি, পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেয়া, এমনকি উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা। এসব সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের অনেকে এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন।
সাংবাদিক হিসেবে আমার ক্যারিয়ার জুড়ে রাজপথে সময় কাটিয়েছি এবং ২০১৮ সাল থেকে ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে রিপোর্ট করছি, ফলে রাজপথ নিয়ে আমার কিছু বিশ্বাস ছিল। আন্দোলনকে উস্কানি দেয়ার অপরাধে ২০১৮ সালে যখন আমাকে জেলে দেয়া হলো তখন কিছু ছাত্রের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তাদের অনেককে এবারের এই তীব্র সহিংসতার সময় আমি আশ্রয় দিয়েছি। অন্যদের দেখতে গিয়েছি। তাদের অনেককে হাসপাতালে নির্যাতন করেছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। এক ধরনের পরামর্শদাতা হয়ে উঠেছিলাম আমি। হ্যাঁ, আমি সরকার পতনের প্রত্যাশা করছিলাম। কিন্তু কখনো ভাবিনি এত দ্রুত এটা ঘটবে। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে বিদায় নেয়ার পর শূন্যতা সৃষ্টি হয়। পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন যেসব ছাত্রছাত্রী, তারা নিজেরা রাস্তায় পুলিশিংয়ের দায়িত্ব নিয়ে নেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে নেতৃত্ব দেন তারাই। এই আমন্ত্রণ মেনে নেন ড. ইউনূস। সেনাবাহিনীর সঙ্গে কিছু আলোচনার পর অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেন আন্দোলনের দু’জন ছাত্রনেতা। যদি নতুন করে উদ্ধার করা ক্ষমতা তাদের হাতেই পড়ে কিনা এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ থাকায় শিক্ষার্থীরাই নতুন সরকারকে তদারকি করতে একটি ওয়াচডগ পরিষদ গঠন করেন।
নতুন এই মন্ত্রিপরিষদের বয়স এক মাসের কম। কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই সম্মানিত নাগরিকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে এই সরকার। অজানা পথে যাত্রা করেছে তারা। তার মধ্যে খুব কম সংখ্যকের রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা আছে, যা আমাদেরকে পরিচালিত করার জন্য প্রয়োজন। সামনে সমস্যা বিপুল। এমনকি অধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কেবিনেটেরও বাংলাদেশিদের যে উচ্চাশা তা পূরণে সমস্যা হতো। ‘মুনসুন রিভোল্যুশন’ নামে পরিচিত যুবকদের এই কম্পনকে স্বাগতম।
আমরা একটি দিনের পর আরেকটি দিন বেঁচে আছি। পালানোর চেষ্টাকারী জেনারেল বা মন্ত্রীর গ্রেপ্তারের খবরে আমরা যখন আনন্দিত হচ্ছি, তবে তারা যথাযথ প্রক্রিয়ায় মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত হতে পারেন- এ জন্যও ব্যথিত হতে পারি। মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত করে আমরাও সাবেক শাসকদের মতো অপরাধ করে বসতে পারি। এই সংস্কৃতি আমাদেরকে দ্রুত ত্যাগ করতে হবে।
আমরা দেখছি। আমরা অপেক্ষায় আছি। আশাবাদী হওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। গত মাসে বিপর্যয়কর বন্যা আঘাত করেছে বাংলাদেশকে। ছাত্রদের ব্যতিক্রমী সুসংগঠিত ত্রাণ তৎপরতা উৎসাহিত করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জোরপূর্বক গুমের সংস্কৃতির ইতি টানার পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা প্রাথমিকভাবে সরকারের সমালোচকদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনের চরিত্রই ছিল এটা। শুধু সময়ই নির্ধারণ করবে যে, এই গ্রীষ্মে বাংলাদেশিদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ কোনো দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনবে নাকি তা হবে শুধু একটি মৌসুমি পরিবর্তন- যে মৌসুম সূর্যের চলাচলের সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যায়।