এক.
যারা সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলছে, বলে ফেলছে, তারা কথাকার হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ কথার ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে, তারপর গাঁথছে কথার পৃষ্ঠে কথা। সেসব কবিতা ও গান হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ কাহিনী বানাচ্ছে, তারা হচ্ছে গল্পিক। এর মধ্যেই খেলা করছে জীবনের শিল্প আর শক্তিগুলো। কিন্তু শক্তির আধার সম্ভবত একই জায়গায়। তা হচ্ছে জীবনকে জীবনের মতো করেই দেখার কৌশল।
একখান থেকেই উৎসারিত হচ্ছে সব। তার সঙ্গে প্রবণতা। গ্রাম বাংলায় গল্পিকের অভাব নেই, রস তামাশা করার বহু মানুষই পাওয়া যায়। তারা সব গুণী মানুষ। তারা কাঁদা, পানি, ছায়া, মেঘ, প্রত্যহিক জীবনের কোনা কাঞ্চি থেকে রস নিতে জানেন। সেই রস তার প্রবণতার রসে মিশিয়ে উদ্দিষ্ট মানুষকে দিতেও জানেন। আঁখ কিংবা খেজুরের কাঁচা রস থেকে তাঁতানো রসের মতো।
আমরা যেটি খাই মজা করে। প্রাকৃতিক প্রতিবেশে কথাকার যত পাওয়া যায়, ততবেশি পাওয়া যায় না কথা আটকে রাখা মানুষ। যাদের ভেতরে কথা তৈরি হয়, প্রকাশ হয় না সহজে। প্রকাশ হলে অন্য ভাষায় হয়। যে ভাষা বড় বেশি গভীর। বড় বেশি উত্তীর্ণ। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে স্বপ্নবান অথচ বোহেমিয়ান হয়ে জীবনকে আপন করা যায় না। এ এক বিশেষ মহত্ব। প্রকৃতির সঙ্গে নিরবে মিশে যাওয়ার, মাংসপেশি থেকে শুরু করে জীবনের গভীরে ঢুকে পড়ার, জীবনকে একটি সঠিক পথে আবিস্কার করার, পৃথিবীকে তুচ্ছ করার, সংসারকে ছেলেখেলা মনে করার, আর অদ্ভুত একটি সুন্দরের জন্ম দেবার এষণা খুব কম মানুষেরই থাকে।
তাদেরই একজন এস এম সুলতান। মাটি থেকে উৎসারিত এক প্রকৃতমানব। যার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় একজন চিত্রশিল্পী। মহান চিত্রশিল্পী।
তারপরও কিছু কথা আছে। শিল্পের এত মাধ্যম থাকতে চিত্রকর্ম কেন জীবনের সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছিল সুলতানের ? বাবা শেখ মোহাম্মদ মেছের আলী ছিলেন ঘরামি। ঘরামির ছেলে বড়জোর লেখাপড়া শিখে কেরানি হবে, সেটিই হবে বড় গর্বের। কিন্তু সুলতান বাল্যকাল থেকেই খড়, কাঠি, কয়লা দিয়ে এদিক সেদিক রেখা আঁকতে আঁকতে কিই বা খুঁজে পেয়েছিলেন ? যা পেয়েছিলেন হয়তো তা সোনার খনিই। হয়তো তার ভেতরেও ‘ইউরেকা’র মতো একটা কিছু উচ্চারিত হয়েছিল নিঃশব্দে।
সে কারণেই সারাটি জীবন তার কেটেছে ছবির সঙ্গে। তার যত সাধন ছবিতে, যত গান ছবিতে, যত কবিতা সব বলেছেন ছবিতে। ছবির মধ্যে পেয়েছিলেন জীবন প্রকাশের অন্য এক সুখ। এ যেন সৃষ্টির পূণনির্মাণ।
আজকের দিনে খাদ্য অনেক দামী। অনেক মূল্যবান। খাদ্য উৎপাদকদের সেই দাম নেই। কিন্তু সুলতান পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেই আমাদের দেশের শক্তির আধারটি ঠিকই আবিস্কার করেছিলেন। কৃষককে দেখেছেন শারিরীক ঐশ্বর্যের এক প্রতীক হিসেবে। একেবারে সত্যি কথা, একজন কৃষকই তো বহু মানুষের শক্তির উৎস্য। তার শক্তিই তো একটি দেশকে সচল করে রাখে। আজ এই কথা হয়তো দেশের মানুষ কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছে, কিন্তু সুলতান বহু বছর আগেই দেখিয়ে গেছেন সেই শক্তিটি কেমন। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন সমৃদ্ধ মানুষের। এঁকেছেন পেশিবহুল সমৃদ্ধ শরীরী মানব-মানবীর কৃষিকাজ, মাছ ধরা, বৃক্ষরোপন ইত্যাদি। সুলতানের শিল্পবিক্ষণ ও চেতনার এই জায়গাগুলো ঠিকই ধরা পড়ে বিশ্বের বড় বড় শিল্পবোদ্ধার দৃষ্টিতে।
সুলতান দাঁড়িয়ে যান বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, পল গগা, সালভাদার দালি, পাবলো পিকাসোর কাতারে। সুলতানের চিত্রকলা বিষয়ে বাংলাদেশের চিত্র সমালোচক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেছেন, “তাঁর কাছে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি; তাঁর আধুনিকতা ছিলো জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তার কাছে ছিলো ‘আধুনিকতা’, অর্থাৎ তিনি ইউরো-কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে”।
আর নিজের সৃষ্ট কৃষক-কৃষানীর পেশীবহুল অবয়ব সম্পর্কে সুলতান নিজেই যা বলেন, তা হলো “আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো -সেটাও রোগা। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি। আমাদের দেশের কৃষক সম্প্রদায়ইতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিলো। অর্থবিত্ত ওরাই তো যোগান দেয়। …আর এই যত জমিদার রাজা মজারাজা আমাদের দেশের কম কেউ না। সবাই তো কৃষিনির্ভর একই জাতির ছেলে। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় অতিকা দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃষ কেন? ওরা রুগ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়। ফসল ফলায়?
দুই.
আমি এস এম সুলতানকে কখনো সাক্ষাৎ দেখিনি। কিন্তু সুলতানকে দেখা হয়েছে বহুভাবে। বাংলাদেশের বহু শিল্পবোদ্ধার বোঝাপড়ার ভেতর তার বিশাল অবস্থানটি দেখেছি। দেখেছি নাসির আল মামুনের বহু আলোকচিত্রের ভাষায়। ‘লাল মিয়া : দ্য প্রিমিটিভ ম্যান’ প্রামাণ্য চিত্রে। যেখানে সুলতান অন্য এক বাঙালি হিসেবে ধরা দেন। যেনবা অনন্য কৃষক তিনি। এই বাংলায় রেখে গেছেন তার অফুরন্ত ফসল। যেই শস্যের অনেক দাম বিশ্বমাণের শিল্প মূল্যায়নে। ঊনিশ ’শ তিরানব্বই সালের কথা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন আলী রেজা হোসেন। পত্রিকার সংবাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তার সঙ্গে আমার জানাশোনা হয়। একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি মেলে ধরেছিলেন এস এম সুলতানকে।
তিনি সপ্তাহান্তে না পারলেও মাসে একবার নড়াইল গিয়ে এস এম সুলতানের সঙ্গে দেখা করে আসতেন। লোকটি কোন শিল্পী নন, এমনটি খুব বেশি শিল্পবোদ্ধাও মনে হয়নি। কিন্তু সুলতানের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় টান। আমি ছোটবেলায় কিভাবে কিভাবে যেন ছবি আঁকার একটি ঘোরের মধ্যে পড়তাম। খুব আঁকতাম। খাতায় কলম দিয়ে, কার্টিজ পেপারে জলরং-এ ছবি একে একে ভরে ফেলতাম। ভাবতাম একদিন অনেক বড় শিল্পী হয়ে যাব। চারুকলার পড়তে না পেরে আমার বড় এক সাহসের জায়গা হয়ে যান এস এম সুলতান। জেনে ফেলি, তিনিও খুব বেশি বনেদি প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেয়া কেউ নন। যখন আলী রেজা হোসেন আমাকে বললেন তার সঙ্গে নড়াইল যাবার কথা, আমার কাছে সেটি ছিল দারুণ এক সুযোগ। কয়েকদিন ধরেই স্বপ্ন দেখছিলাম, শিল্পীর পা ছুঁয়ে আসার এ এক বিরাট সৌভাগ্য।
কুষ্টিয়ার কবি সৈয়দ নাসের কর্ণেল এর মতো গায়ের টি শার্টে যদি ওই মহান শিল্পীকে দিয়ে কলমের টান-টুন মেরে নিতে পারি তাহলে তো কথাই নেই। আমার সঙ্গে স্টিল ক্যামেরা থাকবে, একটি ফিল্ম জুড়ে ছবি তুলবো। সেখান থেকে বেছে বেছে বাঁধাবো। এস এম সুলতানকে নিয়ে একটি লেখা তৈরি করবো। সেক্ষেত্রে তার শিশুস্বর্গ, চিড়িয়াখানা আর সুলতান কুটিরের সব মানুষগুলোর নাম ঠিকানা নোট করে নিতে হবে। মাথার মধ্যে এমনই প্রস্তুতি। কিন্তু কোন এক কাজে আটকা পড়লাম ঠিক যাবার দিনটিতে।
আলী রেজা হোসেন আমাকে অনেক খোঁজ করেছিলেন। আমি যেতে পারলাম না বলে ভাবলাম, যাওয়া যাবে পরে কোন একদিন। পাশাপাশি কেন জানি মনে হচ্ছিল, হয়তো কোনদিন সুযোগ হবে না সুলতান দর্শনের। সুযোগ হয়নি। যারা সুলতানকে স্বচক্ষে দেখেনি, আমি তাদের একজন। কিন্তু এখনও বহুভাবে এস এম সুলতানকে দেখি, দেখার সুযোগ হয়।
উনিশ ’শ সাতানব্বই সালে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার ছিলেন মালিক খসরু। তিনি অন্যরকম এক সুলতান ভক্ত। তার সঙ্গে সুলতানের অনেক স্মৃতি। সেগুলো বেশ বড় গর্বে আমাদের সামনে বলতেন। জিজ্ঞাসা করলে বলতাম, আমি সুলতানকে দেখেছি, কিন্তু অত শত স্মৃতি নেই। নাসির আলী মামুনের ‘গুরু’ নামক সুলতান বিষয়ক অ্যালবামটি দামী এক সংগ্রহ আমার কাছে। ঘরে বড় এক পোস্টারও বাঁধিয়ে রেখেছি এস এম সুলতানের। কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সুবাদে এখন নড়াইলকে আমার অনেকটা নিজের এলাকা বলেই মনে হয়। তাই যাওয়া হয় সুলতানের বাস্তুভিটায়, চিত্রা নদীর পাড়ে, শিশুস্বর্গের সামনে।
তিন.
সুলতান এই বাংলার জীবন সংস্কৃতির এক বলিষ্ঠ চরিত্র। যাকে ছুঁতে পারেনি আজকের কর্পোরেট সংস্কৃতির বাড়াবাড়ি ও গণমাধ্যমের তপ্ত জোয়ার। নিভৃতে অন্য এক জীবনের চর্চা করে গেছেন সারাটিজীবন। যদিও তার জীবনটিই কেটেছে অর্থের অভাব আর বস্তুগত দারিদ্রে। বেঁচে থাকার জন্য পরাক্সমুখ হতে হয়েছে বারবার। হয়তো তিনি বিশ্বাস করেছেন, এদেশে প্রকৃত শিল্পীর জীবন কাটে এভাবেই। যেভাবে দিন কাটে একজন প্রান্তিক কৃষকের। তাই এই প্রখ্যাত শিল্পী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন এক রকমের তৃপ্তি নিয়েই। জীবন সায়াহ্নে তিনি বলেন, ‘আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই।
আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।’ ঠিক এই জায়গাটিতেই আমাদের দায়বদ্ধকার প্রশ্ন আসে। আমরা কী করেছি এস এম সুলতারে জন্য ? তার শিশুস্বর্গকে পারিনি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে, বরং অযত্নে অবহেলায় দিনের পর দিন হারিয়েই যাচ্ছে সুলতানের স্বপ্ন ও নিজ হাতে গড়া বিভিন্ন উপদান। যে বিড়ালগুলো সুলতানকে সারাক্ষণ ঘিরে থাকতো, সেগুলোর কথা অনেকেরই মনে নেই, তার গড়া চিড়িয়াখানাটিও হারিয়েছে তার অস্তিত্ব, এখন স্মৃতিটুকু পড়ে আছে বিভিন্ন মানুষের মুখে মুখে। যা কালের বিবর্তনে হয়তো পরিবর্তিত হচ্ছে। যুক্ত হচ্ছে নানা রং। যা প্রত্যাশা করেননি এস এম সুলতান।
তবে একটি বিষয় খুব ভালো লাগে। নড়াইলের মানুষের কাছে এস এম সুলতান সত্যিই হয়ে এক ‘সুলতান’ হয়ে আছেন। নতুন প্রজন্মের সবাই সুলতানের নাম উচ্চারণ করেন ‘সুলতান সাহেব’ হিসেবে, আর পুরনো দিনের মানুষেরা বলেন লাল মিয়া। যারা সুলতানের কাছে ছবি আঁকা শিখেছে তাদের কাছে সুলতান হচ্ছে ‘লাল দাদু’। কিন্তু সুলতান তো শুধু নড়াইলের নয়। সুলতান সারা বাংলার এমনকি সারা বিশ্বের। সুলতানের জীবন দর্শন ও কাজ যদি আমরা মূল্যায়ণ না করতে পারি, যদি তার স্মৃতিগুলো ঠিকমতো সংরক্ষণ করতে না পারি, তাহলে আমাদের শিল্প সংস্কৃতি নামক বৃক্ষের মূলই যে অনেকটা শুকিয়ে যাবে। মাটি থেকে এসেছে শিল্পের যে শক্তি, সে শক্তি তো আর পাবে না ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।